করোনার ক্রান্তিকালে দুরূহ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনযাপন। ঠিক এমন সময় একটি খবর খুবই নাড়া দিয়ে গেল। আর তা হলো, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ম না মেনে ১৫০ কোটি টাকার বই কিনছে! তাও আবার নির্দিষ্ট কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই। এমনিতেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে নানামুখী সমস্যায়। অনেকেই অফিস-শোরুম-বাসা ভাড়া দিতে না পেরে ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ তো গ্রামের বাড়িতে গিয়ে করুণ জীবনযাপন করছেন। ঠিক এই সময় এমন সংবাদ মনকে বেদনার্ত করে দেয়।
বাংলাদেশে অনেক শৌখিন প্রকাশক থাকলেও সৃজনশীল মূলধারার প্রকাশকের সংখ্যা ৩০০ হবে। তারা সারাবছর বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত। এই প্রকাশকদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লেখকদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সম্পর্ক। দেশে প্রতিবছর যে তিন হাজার থেকে চার হাজার বই প্রকাশ হয়, তা প্রকাশ করেন এসব প্রকাশকই। লেখকরা প্রকাশকের কাছে পা-লিপি জমা দেওয়ার পর কতটি হাত ঘুরে বই প্রকাশ হয়, তা হয়তো এখন অনেকেই জানেন। এ শিল্পে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে কয়েক হাজার পরিবার।
সৃজনশীল বই কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবছর বাজেট খুবই নগণ্য। তা প্রকাশনাশিল্পের জন্য আনন্দের নয়। তার পরও শত বাধা পেরিয়ে ভালোবাসার টানে এ জগতে আছে অনেক মানুষ। জাতীয় গ্রন্থাগার অধিদপ্তর ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র মিলে প্রতিবছর দুই কোটি থেকে তিন কোটি টাকার বই কেনে। বইমেলার বাইরে এই মাধ্যমে সারাদেশের লাইব্রেরিগুলোয় চলে যায় বই। ফলে টাকার পরিমাণের দিকে না তাকিয়ে মানুষের কাছে বই পৌঁছানোকে অনেকে গুরুত্ব দেন। এসব বই কেনা হয় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে তা নিয়ম মেনে।
সম্প্রতি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ম না মেনে ১৫০ কোটি টাকার বই কিনছে। এসব বই কেনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য।
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ তৈরি করা ভীষণ আনন্দের বিষয়। তার জীবনকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং নানা রকম বই শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু এ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নিয়ম না মেনে গুটিকয়েক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে ১৫০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে এমন সুন্দর একটি আয়োজনকে।
বিষয়টি জানার পর পরই বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে নির্বাচিত প্রতিটি বই ৬৫ হাজার কপির ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিলের আবেদন করে সৃজনশীল প্রকাশকদের কাছে উপযুক্ত বইয়ের তালিকা ও নমুনা কপি আহ্বানের মাধ্যমে বাছাই কমিটি কর্তৃক বই নির্বাচন করে দ্রুত ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। আমরা জানি, প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট শিল্প এখন নাজুক অবস্থায়। এটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন লেখক-সাংবাদিক সবাইকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সুলেখক। তিনি লেখকদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার বরাবর প্রকাশনাশিল্পের জন্য প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে। অথচ প্রত্যেক প্রকাশকের কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকার বই নিলে ৩০০ প্রকাশকের কমপক্ষে ৬০০ থেকে দুই হাজার আইটেমের কয়েক হাজার করে বই কেনা সম্ভব। তা হলে কী হতো, ৩০০ প্রকাশক মোটামুটি সমানুপাতিক হারে বই সরবরাহ করতেন। ফলে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকত অনেক পরিবার।
নিয়ম মেনে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে যেসব বই বাজারে আছেÑ এর বেশিরভাগ ভালো বই সংগ্রহ করা যেত। ফলে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরÑ যাদের জন্য বই কেনা হচ্ছে, তারা উপকৃত হতো। অন্যদিকে বেশিরভাগ লেখক বই লেখার জন্য পেতেন রয়্যালটি, প্রকাশক করোনাকালে কাটিয়ে উঠতে পারতেন নিজেদের ঋণের ভার। বেশিরভাগ প্রেস সরব থাকত। বই বাঁধাই যারা করছেন, তারাও ভীষণ দুঃসময় কাটাচ্ছেন। তারাও সুবিধাভোগী হতেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর যাদের বই কিনছিল, এতে লাভবান হতেন কয়েকজন মাত্র। অথচ ৩০০ প্রকাশককে যুক্ত করলে করোনার এই সময়ে টিকে থাকতে পারত কয়েক হাজার পরিবার। দেশের প্রকাশনাশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আজই এগিয়ে আসুন, প্লিজ!
কাদের বাবু : শিশুসাহিত্যিক ও প্রকাশক