দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। কারও মতে এখনো ঊর্ধ্বমুখী আছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাছাকাছি। আবার কেউ বলছেন সংক্রমণ এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। তবে সংক্রমণ যে নিয়ন্ত্রণে নেই তা স্পষ্ট, সব বিশেষজ্ঞই তা স্বীকার করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। প্রবল ছোঁয়াচে ও প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ যখন নিয়ন্ত্রণহীন ও ঊর্ধ্বমুখী তখন জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, সবকিছুতে ঢিলেঢালাভাব দেখা যাচ্ছে।
সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোরও তৎপরতা কমেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এসেছে শৈথিল্য। সামাজিক তথা শারীরিক দূরত্ব কোনো কিছুই আর তেমন মানা হচ্ছে না। এতদিন খুব দরকার ছাড়া বের হননি যারা, তারাও এখন অকারণেই বের হচ্ছেন। নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া বা রাজধানীর প্রধান সড়কে আড্ডার চিত্র এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাব্যবস্থা, করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে নেওয়া উদ্যোগ একের পর এক ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগছে। আবার অনেকে ঘরে থেকেই আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে মানুষ এখন আর ঘরে থাকতে চাইছে না।
কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের চতুর্থ মাসে করোনা সংক্রমণের হার যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন দেশে জনজীবন স্বাভাবিকই বলা যায়। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখতে দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সংক্রমণের ভয় সরিয়ে রেখে জীবিকার সন্ধানে ছুটছে মানুষ। সরকারও চাইছে অর্থনীতির চাকা সচল করতে। এ কারণে সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়েছে অনেক আগে। নতুন করে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা লকডাউনের চিন্তাভাবনা থাকলেও ওইসব এলাকায় দোকানপাট ও শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এখনই একযোগে সারাদেশে
হটস্পটভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করা গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর যদি না হয়, সঠিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া না হয় এবং জনগণ যদি কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলেন; তা হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তিনি বলেন, কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এক লাখ রোগী বাড়বে। তার পর ১০ দিনের মধ্যে রোগীর সংখ্যা আরও এক লাখ বাড়বে। এর পর আরও এক লাখ রোগী বাড়তে সময় লাগবে সাত দিন। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, রাশিয়া ও ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি এ আশঙ্কার কথা বলেন।
দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর ১১৭তম দিনে গতকাল শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৪ হাজার ১৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭ জন হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৩৮ জন মারা গেছেন ২৪ ঘণ্টায়। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯২৬ জন।
প্রয়োজনের চেয়ে কম পরীক্ষা হলেও দেশে আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে অনেক বেশি। গত মাসে আক্রান্তের হার ছিল ২০ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে। সংক্রমণের প্রথম মাসে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩২, দ্বিতীয় মাসে ১১ দশমিক ৫৮ এবং তৃতীয় মাসে ছিল ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
সংক্রমণ বাড়লেও করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ঢিলেঢালাভাব। এখনো নমুনা পরীক্ষা প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। যখন ব্যাপক হারে নমুনা পরীক্ষা দরকার তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা সীমিত করার জন্য ফি নির্ধারণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা পরিহার করতে করোনা শনাক্তকরণ আরটি-পিসিআর টেস্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরীক্ষার প্রতি অনীহা বাড়বে। সংক্রমণ বাড়বে, সঙ্গে মৃত্যুও।
সামনে কোরবানির ঈদ। ঈদ সামনে রেখে ঘরমুখী মানুষের ঢল ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, রোজার ঈদের মতো এবারও মানুষ বাড়িতে গেলে সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। তাই এখনই এ যাত্রা ঠেকাতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে, কোরবানির পশুর হাটে পশু কেনাবেচনার সময় স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি খুবই কঠিন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পশুর হাট কমানোর পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও তাতে কাজে আসবে না বলে মনে করেন তারা।
গত বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করা না হলে কোরবানির পশুর হাট করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই যেখানে সেখানে পশুর হাটের অনুমতি দেওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগেই পশুর হাটে করণীয় নির্ধারণ করতে মত দিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে হাটের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া মহাসড়কের ওপর বা পাশে হাট বসানো যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওই ঢিলেঢালাভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে সংক্রমণ পরিস্থিতিতে। গত ৩১ মে থেকে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর প্রায় সব অফিস আদালত খুলে গেছে। মানুষের চলাচল বেড়েছে। ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও দুই তিন মাসেও স্বাভাবিক হবে না।
এখন সংক্রমণ ঠেকাতে কিছুদিন ধরে সরকার এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কথা বলছে। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন শেষ হয়েছে। আগামীকাল শনিবার থেকে শুরু হবে ওয়ারী এলাকায় লকডাউন। কিন্তু রাজাবাজারে যারা এতদিন লকডাউনে ছিলেন; তারা এখন অন্য এলাকায় যাতায়াত করলে সেখান থেকে সংক্রমিত হতে পারেন। ফলে এ লকডাউন কতটা ফল দেবে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একযোগে হটস্পটগুলো লকডাউন না করলে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনা সংক্রমণের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বোঝা যায়, মহামারী কতদিন থাকবে। কিন্তু দেশে সে পরিকল্পনা তৈরি করেনি। সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে কর্মসূচিগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কথা বলা হলেও কোথাও হচ্ছে, কোথাও তা হচ্ছে না। এত ঢিলেঢালাভাব ও পরিকল্পনায় গলদ থাকলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না।
স্বাস্থ্যবিধির না মানার প্রবণতা বাড়ছে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের সড়ক ধরে ৩শ ফিটের দিকে এগিয়ে গেলে পশ্চিম পাশে কাঁচা মাটির সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে দুটি আবাসন প্রকল্পের পাশ ধরে কয়েক কিলোমিটার সামনে গেলে বরুয়া গ্রাম, যা খিলক্ষেত থানার আওতাধীন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে হলেও দেখে বোঝা যাবে না এটি রাজধানীর অংশ। সেখানে গিয়ে বোঝা যায়নি দেশে করোনা ভাইরাসের মতো মহামারীর তা-ব চলছে। মানুষের মধ্যে নেই শারীরিক দূরত্ব বা মাস্ক ও গ্লাভসের ব্যবহার।
রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা ক্রমশ কমছে। গতকালও সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। অন্যদিকে, রাজধানীর সড়কে ব্যস্ততাও বেড়েছে। এখন প্রধান সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে যানজটও দেখা যাচ্ছে।
গত কয়েকদিনে রাজধানীর গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর, ফকিরাপুল, মতিঝিল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সড়কে যানবাহন বেড়েছে অনেক। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ হরহামেশাই বাসা থেকে বের হচ্ছেন। এতদিন অলিগলিতে আড্ডা সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা প্রধান সড়কেও দেখা যাচ্ছে।
গতকাল উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের পশ্চিম থানা সড়ক ধরে বের হওয়ার পর প্রধান সড়কে গণপরিবহনসহ অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি দেখা গেছে। জমজম টাওয়ারের মোড়ে এখন রীতিমতো স্বাভাবিক দিনের মতো সিগন্যালে থামতে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ। ১৩ নম্বর সেক্টরের সিঙ্গারের মোড় ধরে আজমপুর, রাজলক্ষ্মী ও জসীমউদদীন রোডের সড়কগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ির ভিড় দেখা গেছে। উত্তরার প্রধান সড়ক ধরে এয়ারপোর্টের দিকে এগোতে সারি সারি গাড়ি দেখা যায়।
গত বুধবার মতিঝিলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সামনে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিলেন। কৌতূহলবশত তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কেন তিনি বের হয়েছেন। জবাবে তিনি বললেন, তার এক বন্ধু ব্যাংকে টাকা জমা দিতে এসেছেন, তিনি তার সঙ্গে এসেছেন।
এ বিষয়ে ডা. লেলিন বলেন, চিকিৎসাব্যবস্থা, সরকারের অপরিকল্পিত উদ্যোগ, স্বাস্থ্য বিভাগগুলোর অবহেলার কারণে মানুষ আস্থা হারিয়েছে। মানুষ এখন ঘরে থেকেও আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে এখন মানুষ ঘরে থাকতে চাইছে না। শারীরিক দূরত্বও মানছে না। কারণ মানুষ মনে করছে আজ বা কাল তাকে আক্রান্ত হতেই হবে।