সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খলশিতে এক ঘের ব্যবসায়ীকে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এর রহস্যও উদ্ঘাটন করেছে সিআইডি পুলিশ। ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান (৪০), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩০), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহি (৯) ও মেয়ে তাসনিমকে (৬) ঘরের মধ্যে জবাই করে হত্যা করেছে তারই ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম। সে কোনো কাজ করত না। এ কারণে তাকে প্রায়ই তিরস্কার করতেন বড় ভাই শাহিনুর ও ভাবি সাবিনা। এতে ক্রুদ্ধ হয়েই বড় ভাইকে সপরিবারে হত্যা করে রায়হানুল। পুলিশকে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে রায়হানুল বলেছে, ‘শয়তান আমার ওপর ভর করেছিল। তাই আমি এটা করেছি।’
গতকাল বুধবার বিকাল ৫টায় হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন বিষয়ে সাতক্ষীরায় সংবাদ সম্মেলন করেন সিআইডি পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক। তিনি জানান, হত্যায় ব্যবহার করা চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। সে সময় হত্যাকারীর সঙ্গে থাকা তোয়ালেটিও উদ্ধার করা হয়েছে তার ঘর থেকে। ডিআইজি আরও বলেন, সন্দেহজনক হিসেবে নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ
করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে দোষ স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছে। মূলত ভাই ও ভাবির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরেই এ নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম কোনো কাজ করত না। ফলে রোজগারও ছিল না। ৯-১০ মাস আগে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে যায়। এর পর থেকে বড় ভাই শাহিনুর রহমানের সংসারেই সে খাওয়া-দাওয়া করত। এটা নিয়ে ভাই-ভাবি বকাঝকা করতেন। হত্যাকা-ের আগের দিন অর্থাৎ গত ১৪ অক্টোবর রাতেও রায়হানুলকে তার ভাবি গালমন্দ করেন। বলেন, ‘কাজ করে না। শুধু খাই খাই।’ এমন তিরস্কারের পরই রায়হানুল ভাবিকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক জানান, গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় দুটি ঘুমের বড়ি ও দুটো কোমল পানীয় কেনে রায়হানুল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ি ফিরে একটি পানীয়ের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভাবি ও ভাইপো-ভাইজিকে খেতে দেয়। রাত দেড়টার দিকে বড় ভাই শাহিনুর রহমান মাছের ঘের থেকে ফেরেন এবং রায়হানকে ফের তিরস্কার করেন। তখন সে টিভি দেখছিল। বড় ভাই বলেন, তুই বিদ্যুৎ বিল দিতে পারিস না, টিভি দেখিস কেন? রায়হানুল বড় ভাইকে বলে, তুমি মাথা ঠা-া করো। এ মাসের বিদ্যুৎ বিল আমি দেব। ততক্ষণে সে অন্য পানীয়টিতে অবশিষ্ট ঘুমের বড়িটি মিশিয়ে ভাইকে খেতে দেয়। বলে, এটা খাও। মাথা ঠা-া করো। শাহিনুর ছোট ভাইয়ের হাত থেকে নিয়ে পানীয়টি পান করেন।
সিআইডির ডিআইজি জানান, সেদিন রাত ৩-৪টার দিকে লুঙ্গি পরে একটি তোয়ালে গায়ে বাড়ির ছাদ দিয়ে বড় ভাই শাহিনুর রহমানের ঘরে প্রবেশ করে রায়হানুল। এর পর ঘুমন্ত সহোদরকে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। এর পর গামছা দিয়ে গলা চেপে ধরে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ভাইয়ের হাতের রগ কেটে দেয় ও পা বেঁধে রাখে। তার পর ভাবির ঘরে প্রবেশ করে ভাবিকে কোপ দেয়। ভাবিকে কোপ দেওয়ার পর তার চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় দুই শিশুর। সেটিই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ওদেরও হত্যা করে রায়হানুল। তবে নিতান্তই অবুঝ হওয়ায় প্রাণে রক্ষা পায় শাহিনুরের ছয় মাস বয়সী মেয়ে মারিয়া সুলতানা। ওকে হত্যা না করে মায়ের লাশের পাশে ফেলে রাখা হয়। রায়হানুলের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, এ হত্যায় সে একাই জড়িত।
দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা এ হত্যাকা-ের জেরে গত মঙ্গলবার একই গ্রামের আবদুর রাজ্জাক (২৮), আবদুল মালেক (৩৫) ও আসাদুল ইসলামকে (২৭) গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি পুলিশ। রাজ্জাক ও মালেক নিহত শাহিনুর রহমানের প্রতিবেশী এবং আসাদুল ইসলাম শাহিনুরের হ্যাচারির কর্মচারী। তাদের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিষয়ে সিআইডি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, তদন্ত এখনো চলছে। যদিও এ পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ততার কোনো আলামত মেলেনি। প্রয়োজন না হলে তাদের রিমান্ডে আনা হবে না জানিয়ে তিনি যোগ করেন, এ হত্যাকা-ে একজনই জড়িত।
১৫ অক্টোবরের এ হত্যাকা-ে নিহত শাহিনুর রহমানের শাশুড়ি ময়না বেগম অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে কলারোয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন পরবর্তী রাতেই। মামলাটি তদন্তভার নেয় সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশ।