রাজশাহীতে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা নদীও এখন দূষণের কবলে পড়ছে। নদীতে শহরের কঠিন ও তরল দুই ধরনের বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। এসব বর্জ্য গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। রাজশাহীর নদী গবেষকরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এখনই নদী দূষণ থামাতে না পারলে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়িঘরের ভাঙা টাইলস, পরিত্যক্ত কংক্রিটের টুকরোর মতো শক্ত আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে নদীতে। এ ধরনের শক্ত উচ্ছিষ্ট জিনিস ফেলার পেছনে কাজ করছে নদী দখলের মনোবৃত্তি। এ দৃশ্য আরও স্পষ্ট শহর রক্ষা বাঁধজুড়ে। ইতোমধ্যে শহর রক্ষা বাঁধে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
শহরের ভেতর পদ্মার পাশের এলাকাগুলোর বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি সব ময়লা-আবর্জনা নির্দ্বিধায় নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরের বুলনপুর, কেশবপুর, শ্রীরামপুর, কুমারপাড়া, সেখের চক, পঞ্চবটি, তালাইমারী ও শ্যামপুর এলাকা শহর রক্ষাবাঁধ ও নদীসংলগ্ন হওয়ায় বসতবাড়ির গৃহস্থালি সব ময়লা-আবর্জনাই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া পাঠানপাড়া, দরগাপাড়া, বড়কুঠি, শ্রীরামপুরসহ শহর রক্ষা বাঁধের নানা স্থানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁর সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন এবং বর্জ্য সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া শহরের পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা নদীতেই পড়ে।
নদীতে এভাবে ময়লা বর্জ্য ফেলার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, শহরের মধ্য থেকে স্লুইস গেটের মাধ্যমে যে তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে, তার মধ্যে দরগাপাড়া এলাকায় তরল বর্জ্যরে মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। এসব বর্জ্যরে ফলে পদ্মা নদীর পানিতে দূষণ বাড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়বে পদ্মায় জলজ জীববৈচিত্র্য।
সেভ দ্য ন্যাচারের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যাগ। এসব নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। কমিয়ে দিচ্ছে পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য। পলিথিনের ব্যবহার কমানোর আন্দোলন করে কোনো লাভ হচ্ছে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগে পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের যে তরল বর্জ্য যাচ্ছে, তা গবেষণা করে দেখেগেছে দূষণের মাত্রা ব্যাপক। আর এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর আগে যেমন পদ্মা নদীতে শুশুক দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না। মাছের পরিমাণও বহুলাংশে কমে গেছে। এ ছাড়া পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে। তবে বর্ষাকালে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে গেলে তখন গেট বন্ধ থাকে; যাতে পদ্মার পানি শহরে প্রবেশ না করে। শহর রক্ষা বাঁধের সবচেয়ে বেশি দখলের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় বুলনপুর থেকে শ্যামপুরে। এ অংশে শহর রক্ষা বাঁধ দখল করে নানা স্থায়ী স্থাপনা যেমন গড়ে উঠেছে, বাঁধেও ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী স্থাপনাও বাড়ছে দিনকে দিন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, নদীতে সলিড কিংবা লিকুইড কোনো বর্জ্য ফেলা উচিত না। কারণ লিকুইড বর্জ্য পানিতে মিশে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে। এতে জলজ প্রাণী মারা যায়। আর সলিড বর্জ্য ফেলা হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ আর স্বাভাবিক থাকে না। তাই অতি দ্রুত এসব বন্ধ করা দরকার।