চাহিদার চেয়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে। বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপসিটি চার্জের নামে কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের দিতে হচ্ছে। এর মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় (বেজা) ‘বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে অনেক উদ্যোক্তা। এতে গ্রিড বিদ্যুতের চাহিদা আরও কমবে। বাড়বে সরকারের লোকসান। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বিভাগের হস্তক্ষেপ চেয়েছে পিডিবি। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি গত ৯ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে সংস্থাটি।
বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর প্রচলিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র সরাসরি পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে বাধ্য। বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেই গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে। চাইলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনতে পারে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটের কম। ফলে সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে। আবার সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সক্ষমতা না থাকায় স্থাপিত ক্ষমতার একটি অংশ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান) অনুসারে
২০৩১ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ৪০ হাজার মেগাওয়াট। এ সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। এমন পরিস্থিতিতে মাস্টারপ্ল্যানের বাইরে নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাওয়ার সেলও বলছে, ২০৩০ সালের হিসাব অনুযায়ী চুক্তি হওয়া এবং নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাইরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, যা বিদ্যুৎ খাতের ভারসাম্য নষ্ট করবে বলে আশঙ্কা পিডিবির।
পিডিবির তথ্য মতে, বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুসারে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। গত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে ৫৯ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এ সময়ে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি গেছে ৫৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিক্রি না বাড়লে পিডিবির লোকসান বাড়তেই থাকবে।
বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো পিডিবির চিঠিতে বলা হয়েছে, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান-২০১৬ অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে। অনেক প্রকল্প পরিকল্পনাধীন। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বিদ্যুৎ চাহিদাও মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বেজার আওতাধীন বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও মাস্টারপ্ল্যানে রাখা হয়েছে। যার অধিকাংশই বাস্তবায়নাধীন। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ও গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন উন্নয়ন এবং নির্মাণে কাজও চলছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বেজার বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এসব বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত হলে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণের হার কমবে। আবার বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ একক ক্রেতা হিসেবে পিডিবির কাছে বিক্রির প্রস্তাব আসবে। এতে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত বা স্থাপিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হবে না। কিন্তু চুক্তি অনুসারে পিডিবিকে মাসিক ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ের প্রকল্পগুলোর জন্য বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে। এগুলো পরিশোধ করতে হবে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ কমবে। ফলে আর্থিকভাবে পিডিবি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।