সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী মানুষগুলোকে একটু ভিন্নভাবে দেখা হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় এরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে নিজের এবং সমাজের সঙ্গে। কর্মের অক্ষমতায় ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত হয় অনেকে। ব্যতিক্রম কিছু সাহসী উদ্যমী প্রতিবন্ধী সমাজের অন্যদের মতোই সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে কৃষিতে জীবিকা নির্বাহ করে। এ পথেও তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে বেশি বাধা সামাজিক। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সরকারের প্রতিবন্ধী কৃষক সহায়ক নীতি নেতা হলে বদলে যাবে লক্ষাধিক কৃষকের ভাগ্য।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার সুতিপাড়া ইউনিয়নের বালিথা গ্রামে শারীরিক প্রতিবন্ধী কৃষক সুরুজ মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, কৃষিকাজ করে সংসার চলে। জন্মগতভাবে তার ডান পায়ের চেয়ে বাম পা খাটো। শারীরিক অক্ষমতার জন্য শস্য কোনো টুরকি মাথার ওপর নিতে পারেন না, কোমরে ভর দিয়ে সার, বীজ, শস্য আনা-নেওয়া করতে হয়। বাড়ির পাশের একখ- জমিতে এই শীতে চাষ করেছেন মুলা, ধনিয়া। সঙ্গে সারিবদ্ধ আখের চারা লাগিয়ছেন। মুলা, ধনিয়া তোলার পর জমিতে থাকবে আখ। এসব বিক্রি করেই চলবে তার সংসার।
এ গ্রামের আরও একজন প্রতিবন্ধী কৃষক মো. জসিম জানান, কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল তার পরিবার। এখন জমিতে রোপণ করেছেন কচু সবজি। এর সঙ্গে আখের চারা। শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে নানাভাবে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
সুতিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম আমাদের সময়কে বলেন, অনেকে শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়ার পরও ভিক্ষাবৃত্তি করেন। অথচ তারা নিজের অক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে অন্যসব মানুষের মতোই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সরকারিভাবে যখন যে সহযোগিতার দরকার সেটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি সামর্থ্যবানদের প্রতিবন্ধী কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
ধামরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, এ থানায় কতজন প্রতিবন্ধী কৃষক আছে জানা নেই। তবে খোঁজ পেলে তাদের যথাযথ সহযোগিতা করা হবে।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামিউল হক আমাদের সময়কে বলেন, শারীরিক চ্যালেঞ্জ নিয়েও প্রতিবন্ধী এ কৃষকরা শস্য উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর মাধ্যমে জাতীয় কৃষি উৎপাদনে তাদের অবদান রাখছেন। তাদের যে কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে দেওয়া হবে।
সুরুজ, জসিমের মতো আরও অনেক প্রতিববন্ধী কৃষকের তথ্য পাওয়া গেছে দেশের রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, বাগেরহাট, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও বরগুনা জেলায়। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী দেশে ১ লাখ ১৫ হাজার ১৫৯ প্রতিবন্ধী কৃষির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কৃষকরা তাদের জন্য যেসব বাধা মনে করেন, স্থানীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য কৃষিবিষয়ক বিশেষ সুযোগ সুবিধা নেই। কৃষিতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। কৃষিতে নারীর অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তিতে রয়েছে অস্বচ্ছতা। নিজস্ব জমির অভাব, বর্গা চাষ পদ্ধতি অস্বচ্ছ। বর্গাচাষিরা ও ভূমিহীনরা সরকারি সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকার পায় না। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও ক্রয়ের জন্য মূলধনের অভাব। নেই আধুনিক প্রশিক্ষণ। যথাসময়ে যথাযথ তথ্যের অভাব। মূলধনের অভাব, মূলধন পাওয়ার সমস্যা; প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, সুদের উচ্চহার ইত্যাদি। মধ্যস্বত্বভোগী, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বীজ, মৎস্য ও প্রাণীর জাত কমে যাচ্ছে। রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, দমন ও প্রতিরোধ সম্পর্কে ধারণা কম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির (বিপিকেএস) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আবদুস সাত্তার দুলাল আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এ যেভাবে গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভর্তি সংক্রান্ত বৈষম্যের প্রতিকার; গণস্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি এসেছে। কৃষিনীতিতে প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী যন্ত্র উদ্ভাবনের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে কৃষি মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করা উচিত। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে চ্যালেঞ্জিং পেশায় এগিয়ে আসতে পারবে প্রতিবন্ধীরা।
এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও তাদের উন্নয়নে বর্তমান সরকার যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণে নিরলসভাবে যে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩-এ প্রতিবন্ধীদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কৃষকদের মতো কোনো পেশা বা গোষ্ঠীর কথা ভিন্নভাবে উপস্থাপন নেই। যে পেশায় থাকুক প্রতিবন্ধীরা অধিকার বঞ্চিত হবে না।
কুষ্ঠ ও সাধারণ প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থা দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিএলএমআইবি) প্রোগ্রাম সাপোর্ট কো-অর্ডিনেটর জিপ্তাহ বৈরাগী জানান, সরকারি নীতিমালা ও কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী, নারী ও অতি দরিদ্রদের অগ্রাধিকার কম। প্রতিবন্ধী ও দরিদ্রদের জন্য জলাশয় ব্যবহারে অগ্রাধিকার কম। প্রতিবন্ধীদের জন্য যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবস্থা অভাব। সরকারি সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। কম সুদে ও সহজে ঋণ সুযোগের অভাব বিশেষভাবে নারী ও বর্গাচাষিদের। জনবলের অভাবে সহজে সেবা পাওয়া যায় না (কৃষি, প্রাণী ও মৎস্য)। বর্গা আইন মনিটরিংয়ের অভাব। কৃষি বিপণনে ও বাজার মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি জনবল ও সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিবন্ধী কৃষকদের জন্য পৃথক কোনো পলিসি এখন পর্যন্ত নেই। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮-তে নারীদের বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আগামীতে প্রতিবন্ধী কৃষকদের বিষয়টি সম্পৃক্ত করা দরকার। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণের সময়ে ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধীদের আরও সুযোগ বাড়ানো হয়, সে ব্যবস্থা করা হবে।
উল্লেখ্য, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮৫.২৪ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষিতে জড়িত। ৬৮.১০ শতাংশ কৃষির সম্পর্কিত বিভিন্ন খাতে জড়িত। কৃষির বাইরে অন্য পেশায় আছে ১৪.৭৬ শতাংশ।
সরকারি তথ্যানুযায়ী, দেশব্যাপী এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে।