জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সিডর, আইলা, আম্পানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। মূলত বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর উৎসমুখ ভারত, নেপাল ও চীন। সেসব নদীর উজান থেকে আসা পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয়। ভারত প্রতিটি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে দেওয়ায় বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই হাজার কিলোমিটার হারিয়ে যাওয়া নদীপথ আর ফিরিয়ে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় মাত্র ৪০০ কিলোমিটার নৌপথ কোনোরকমে টিকে আছে। গত ৫০ বছরে দেশের ছোট-বড় নদ-নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে কোনোরকমে বেঁচে থাকা নদ-নদীগুলো যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এসব অঞ্চলের কৃষি, জনস্বাস্থ্য, প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এক সময়ের বগুড়ার প্রমত্তা নদী করতোয়া, গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের ধরলার মতো নদ-নদীগুলো খালে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে এসব নদীর হাঁটুপানি মানুষ হেঁটে পার হতে পারে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মার অনেক স্থান এবং তিস্তার ডালিয়া থেকে শুরু করে গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্রের মুখ পর্যন্ত প্রায় এক-দেড়শ কিলোমিটারে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে। বিশেষ করে ডালিয়া পয়েন্ট থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার বিশাল চরের বুকে কৃষক এখন নানাজাতের ফসল চাষাবাদ করছে। দেখলে মনে হয়, নদী নয়, যেন ফসলের মাঠ। অথচ এসব নদীর ওপর এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা এক সময় নির্ভরশীল ছিল। নদীর পানিতে চাষাবাদ হতো নদীর দুই পারের জমিতে। এখন নদীতে পানি না থাকায় নদীর পানিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। নদীতে যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা আজ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। পালতোলা নৌকার চিরপরিচিত সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। বরং নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পালতোলা নৌকার চলাচল ও খেয়া পারাপার বলতে গেলে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। উল্লেখ্য, তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে গেছে। ফলে তিস্তার ভাটিতে শুষ্ক মৌসুমে আর পানি থাকে না। ফলে প্রায় ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এখন এই ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে কৃষকের বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ শস্য বছরে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও পানি সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে। এর পরও ৪৩ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার বাইরে ছিল। ২০১৪ শস্য বোরো চাষে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সেচ সুবিধা পেয়েছে মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমি। ২০১৫-১৬ শস্য বছরে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টরে, আর ২০১৭ শস্য বছরে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমি। যদিও ২০১৯ শস্য বছরে এসে এর পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যদি কৃষক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দেয়, তা হলে প্রতি হেক্টরে খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে কৃষককে বাড়তি জোগান দিতে হবে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বলেন, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ২৫ জানুয়ারি থেকে সেচ দেওয়া শুরু করা হয়। কিন্তু তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে আসায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আর সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কস্ম এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এখন এসব চাষযোগ্য জমিতে কৃষককে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিতে হবে।
মূলত ১৯৯৩-৯৪ শস্য বছর থেকে তিস্তা অববাহিকা ও এর সংযোগ খালের মাধ্যমে ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন চাষাবাদের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। যা ২০০৬-০৭ শস্য বছর থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোরো মৌসুমেও সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হয়। উল্লেখ্য, আমন মৌসুমে মোট সেচযোগ্য ৭৯ হাজার ৩৭৯ হেক্টর জমির প্রায় পুরোটাই সেচ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হলেও বোরো মৌসুমে পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে সেচ সাফল্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক। মূলত তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য তিস্তার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় তিস্তা এখন অনেকটাই মরাখালে পরিণত হয়েছে। দুচোখ যতদূর যায়, দেখা যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। একমাত্র ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তার এই মরণদশা। আবার বর্ষা মৌসুমে কোনোভাবে ভারতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে কিংবা স্বাভাবিক বন্যা দেখা দিলে গজলডোবা ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া হয়। ফলে তিস্তা ব্যারাজের পক্ষে পানির চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তখন তিস্তা ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া হয়। ফলে বন্যা দেখা দেয়। অনেক সময়ই অসময়ে বন্যার কারণে আমাদের ফসল-ফলাদি নষ্ট হয়ে যায়। এভাবেই এ অঞ্চলের মানুষের কপাল প্রতিবছরই কমবেশি পুড়ছে। অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানির সংকট আর বন্যা মৌসুমে উজানের বাড়তি পানির ঢলে জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এমনকি পানির অভাবে নদীগুলো এখন নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে উজানের পানি ঢুকলেই নদীর ধারণ ক্ষমতা না থাকায় সে পানি পাড়ের ওপরে উঠে বন্যার সৃষ্টি করছে। এই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা! অবশ্য সরকার বাস্তব এ অবস্থার কারণে ব্যয়বহুল হলেও নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই ব্রহ্মপুত্রের নাব্য ফেরাতে বাহাদুরাবাদ থেকে উত্তরে কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্ত পর্যন্ত নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রমের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি, তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত, নেপালের সঙ্গে নতুন করে নৌপথ চালু হবে। ফলে স্বল্প সময়ে কম খরচে পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বাস্তবে নদীর হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফেরাতে পারলে মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে নৌপথও চালু করা যাবে। যে কারণে সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা আশা করছি, শুধু ব্রহ্মপুত্র নদই নয়, উত্তরাঞ্চলের পদ্মা, তিস্তা, করতোয়া নদীসহ গুরুত্বপূর্ণ সব নদ-নদীতে ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিয়ে পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
মূলত উজানের পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা নদীতে তীব্র পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল চরের। যেখানে শুধু বালু আর বালু। এসব চরের বুকে বসতবাড়ি গড়ে উঠছে এবং চরে ধান, সবজিসহ নানাজাতের ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। পাল্টে গেছে নদী অববাহিকায় বসবাসরত মানুষের জীবনের গতি। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের তরফে জানা গেছে, বিশেষ করে সেচভিত্তিক কার্যক্রম এমনভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের জন্য শস্য মৌসুমে ১০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন হলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ কিউসেক পানি। ফলে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের আওতায় বোরো মৌসুমে সেচ দেওয়া সম্ভবপর হয় না। ফলে এ অঞ্চলের চাষাবাদ পরিচালনার জন্য প্রতিনিয়তই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখন নিচে নেমে যাচ্ছে। এসব কারণেই উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো খনন করে পানি ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা হলে ভূউপরিস্থ পানির ওপর সেচভিত্তিক চাষাবাদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ অনেকাংশেই রক্ষা হবে। সরকার উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক নদীর পানি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে, এটাই এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা।
আব্দুল হাই রঞ্জু : কলাম লেখক