সেদিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক আবেগঘন দিন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ের মণি যে মহান নেতাকে পাকিস্তানি শাসকরা বন্দি করে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার অপচেষ্টা করল তাদের জেলখানায়, সেই তিনিই সদর্পে ফিরে এলেন নিজের মুক্ত দেশে জাতির পিতা হয়ে। হানাদারম্ক্তু নিজ ভূমে পা রাখলেন তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর মেঘমুক্ত শীতের রোদেলা বিকেলে। হাজারো-লাখো আবেগাপ্লুত জনমানুষের দিগন্তবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির সুমধুর আবহে তিনি শুধু অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়েছিলেন আর অবিরল অশ্রুধারায় বুক ভাসিয়েছেন। তার সঙ্গে বুক ভাসিয়েছে লাখো মানুষ তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে। বাংলার সহজ-সরল মানুষদের এমন ভালোবাসা তার মন থেকে হয়তো মুছে দিয়েছিল সোনালি যৌবনের চার হাজার ছয়শ বিরাশি দিনের জেলখাটার বেদনা। নয়তো মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার মানুষদের সামনে এমন করে কাঁদে কেউ?
রাস্তার দুপাশে অপেক্ষমাণ কয়েক লাখ মানুষের অভিবাদন গ্রহণ করতে করতে আধা ঘণ্টার পথ কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে গাড়িবহর যখন থামল একাত্তরের ৭ মার্চের অতুলনীয় ভাষণস্থল বিশাল রেসকোর্স ময়দানে, আরও কয়েক লাখ মুক্ত বাঙালি, মুক্তিসেনা হাত উঁচিয়ে গর্জে উঠল জয় বাংলা স্লোগানে, যে সেøাগান তাদের শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে। নৃত্যরত হাতগুলোকে সম্বোধন জানিয়ে তিনি আবেগে ভাসলেন, কম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘গত ৭ মার্চ এই ঘোড়দৌড়ের ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলার মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালিও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।’
দেশে ফিরে এসে একদিনও বিশ্রাম নেননি হিমালয়ের মতো মজবুত মনের এ মহাপুরুষ। শুরু হলো তার স্বাধীন দেশের বিধ্বস্ত চারণভূমিতে পথচলা। প্রায়-ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। ধ্বংসস্তূপ চারদিকে। নেই রাস্তাঘাট, নেই চলাচলের বাহন, নেই খাবার সাড়ে সাত কোটি মানুষের, তীব্র শীতে নেই গায়ে দেওয়ার বস্ত্র, ব্যবসা নেই, বাণিজ্য নেই, চাষের গরু নেই, বীজ নেই, সার নেই। চারদিকে শুধু নেই নেই। এই নেই নেই-এর মধ্যেই জাত বীরের মতো হাতে তুলে নিলেন দেশ চালানোর দায়িত্ব। অমিত বিক্রমে নেমে পড়লেন কাজে। জানতেন, সামনে শুধু কাজ আর কাজ। করতে হবে সব দ্রুত। বাঁচাতে হবে মানুষকে। থেমে থাকার কোনো জো নেই। চলতে হবে অনবরত, অবিরত; চোখ রাখতে হবে শুধু সামনের দিকে। গড়ে তুলতে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে, সাহস জোগাতে হবে দিশাহারা মানুষগুলোর মনে। একই সঙ্গে স্বাধীন দেশটির জন্য আদায় করতে হবে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি যা ছিল তখন অতি জরুরি।
শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর আরেকটা যুদ্ধ, সবকিছু পুনর্গঠনের যুদ্ধ, দেশ গড়ার যুদ্ধ, বেঁচে থাকা মানুষদের নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ; স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের স্যাবোটাজ আর আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বানানোর অপকৌশলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ সেবা করার মানসিকতা যিনি পোষণ করেছেন সারা জীবন, সেই তিনিই স্বদেশে ফিরে এসে দেশ্রপ্রেমিকের দৃষ্টিটি বিস্তৃত করে দিলেন ভবিষ্যতের দিকে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যে ডুবে থেকেও তিনি এক এক করে হাত দিলেন বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারের কাজে। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন; এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি বিপর্যস্ত দেশকে অভাবনীয় দক্ষতার সঙ্গে পুনর্গঠন করেন। ধ্বংসস্তূপের ওপর উন্নয়নের পরশ লাগিয়ে তিনি সজীব করতে থাকেন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ব-দ্বীপ অঞ্চলটিকে।
প্রথম সংস্কারমূলক প্রয়াস কৃষি খাতে। বিপুল জনগোষ্ঠী জড়িত যে কৃষি খাত, সেটিতে সংস্কারের লক্ষ্যে কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জামির খাজনা মাফসহ ব্যক্তিমালিকানায় পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। এ ছাড়া তার স্বল্পকালীন প্রশাসনিক আমলে তিরিশ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকদের মধ্যে এক লাখ আশি হাজার গাভী বিতরণ এবং চল্লিশ হাজার পাম্পের ব্যবস্থাকরণ, ভারতের সঙ্গে আলোচনাক্রমে শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীতে চুয়ান্ন হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা লাভসহ গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প চালু করার মতো অভাবনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান তৈরি করেছেন তিনি, পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন শুরু করেছেন এবং সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জবাবদিহির বোধ তৈরি করেছেন। এমনকি আইনের শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে এক বছর সময়ের মধ্যে প্রায় দেড়শ আইন প্রণয়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
কালো টাকার মালিকরা ক্ষিপ্ত হবে আর মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অভিশাপ দেবে, এটা জানা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু একশ টাকার নোট অচল ঘোষণা করেছিলেন মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনমানুষকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। তিনি ফিরে না এলে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হতো না; ৩৭ হাজার প্রাথমিক স্কুলও সরকারিকরণের আওতাভুক্ত হতো না; ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো না; এক লাখ পঁয়ষট্টি হাজার প্রাথমিক শিক্ষকও সরকারি হতে পারতেন না; রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায় শূন্য থাকা সত্ত্বেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেত না কিংবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষিত হতো না; দেশের সব শিক্ষক নয় মাসের বকেয়া বেতন পেতেন না; নয়শ কলেজভবন আর চারশ মাধ্যমিক স্কুলভবন পুনর্নির্মিত হতো না; এমনকি মাত্র পাঁচ মাস সময়ের মধ্যে যুগান্তকারী ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনও গঠিত হতো না। সব শ্রেণির মানুষের সন্তান-সন্ততিদের প্রাইমারি শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার মতো গণমুখী উদ্যোগ আমরা দেখতে পেতাম না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কী তা দেশবাসী বুঝতেই পারত না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে তো বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল এক কথায় অসাধারণ।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫- মাত্র সাড়ে তিন বছর। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু এ সময়টুকুই পেয়েছিলেন। যদি তিনি না আসতেন তা হলে বাংলাদেশের তখন কী অবস্থা হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশকে দেখলে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রায় বিশটি বছর ধরে বাংলার মাটিতে ছিল শুধু ক্রুরতা, হঠকারিতা, ষড়যন্ত্র আর লোভ-লালসার বহির্প্রকাশ। উন্নয়নের কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়ে পেছনে ঠেলে ফেলে দেওয়ার প্রয়াস ছিল সর্বত্র সুস্পষ্ট। তিনি এসেছিলেন বলেই নব্যস্বাধীন বাংলাদেশ বেঁচে গিয়েছিল বিপর্যয়ের হাত থেকে, ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে, আরেকটি ‘পাকিস্তান’ হওয়ার হাত থেকে। অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে বঙ্গবন্ধুই রক্ষা করেছেন মুক্ত বাংলাদেশকে। বিশ্বের দরবারে নব্যস্বাধীন দেশের জন্য একটি মর্যাদার আসন তৈরিসহ তিনি ‘এগারো হাজার কোটি টাকার ধ্বংসস্তূপের ওপর আরও তেরো হাজার কোটি টাকার উন্নয়নস্তম্ভ দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।’ এমনটি শুধু বঙ্গবন্ধুর মতো একজন জাত বীরের পক্ষেই সম্ভব। তাই তার সেদিনের ফিরে আসা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে একাকার হয়ে। বাংলাদেশের যাত্রা শুরু বঙ্গবন্ধুর যেসব দিকনির্দেশনায়, সেসব নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ করোনা-মহামারীতেও তারই সুযোগ্য কন্যার পরিশীলিত দূরদর্শী নেতৃত্বে। আরও এগিয়ে যাবে অনেক দূর, বহুদূর। বঙ্গবন্ধুর কন্যাই প্রমাণ করে দিলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে বিশটি বছরের বেশি সময় ধরে যারা বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনে নানা ছিদ্র অন্বেষণে ব্যস্ত ছিল তারা তা করেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। সত্যিকার অর্থে, বঙ্গবন্ধুই তৈরি করে দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি মাত্র সাড়ে তিন বছরে। এই মজবুত ভিত্তিই বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে শক্তি জোগাচ্ছে।
ড. এম এ মাননান : কলাম লেখক ও উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়