অতিসম্প্রতি বিশ^ব্যাংক করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে মর্মে যে মন্তব্য করেছে, এর উপযুক্ত প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ^ব্যাংকের মন্তব্যটি ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ বলে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে পৌনে পাঁচ বছর আগের ঘটনা। ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আয়োজিত ‘২৫তম ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটিজ মার্কেট গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক বিশ্ব কর্মশালা (১৬-২৬ মার্চ ২০১৫) অনুষ্ঠিত হয় ওয়াশিংটনে। ৩৭টি দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ এবং রেগুলেটর অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে উচ্চপর্যায়ের কয়েক প্রতিনিধিকে ইউএস-এসইসির সিনিয়র ও প্রভাবশালী কমিশনার, প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ, মাইকেল এস পাইওয়ার মধ্যাহ্নভোজ সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে আমাকে (চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ও সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান), ভুটান ও করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের সিইও অর্থাৎ সার্ক রিজিয়ন থেকে তিনজনকে ওই ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। অন্যান্য রিজিয়নের দু-একজন করে বিশিষ্ট প্রতিনিধি সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি। ভোজসভায় শুধু ভূরিভোজ নয়, আঞ্চলিক তথা নিজ নিজ দেশভিত্তিক উন্নয়ন অর্থনীতির হালহকিকত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা কার কোন পর্যায়ে, তা নিয়ে মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ই ছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী ওই ভোজসভার অন্যতম মেন্যু। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে অগ্রসর হতে চাইছে, এগোচ্ছে। অন্যদের অবস্থাও জানা হলো। মাইকেল এস পাইওয়ার সবার কথা শুনে উপসংহারে যা বললেন, এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল- ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভীপ্সা শুধু অনিবার্য প্রত্যাশা উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, তা অর্জনে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অর্জন-বর্জন ও সংস্কারের সাধনায় সাফল্য লাভ করতে হবে। প্রত্যেকেরই উচিত হবে নিজেদের আত্মশক্তি (ঝঃৎবহমঃয), অন্তর্নিহিত দুর্বলতা (ডবধশহবংং), সম্ভাবনা ও সুযোগ (ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু) এবং হুমকি (ঞযৎবধঃং) বা চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে শনাক্ত করে নিজস্ব সব শক্তি ও সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার এবং চিহ্নিত দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় মেধাবী এবং কৌশলী পথ-পন্থা বের করা আর তা বাস্তবায়নে রীতিমতো ঐক্যবদ্ধ সাধনা কিংবা সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনিবার্যতা থেকেই যাবে।’
মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ‘অন্তর্নিহিত সহনশীল সলিলাশক্তি’ (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) ও সম্ভাবনার সাধনা-পরিচর্যা যেমন জরুরি, তেমনি এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অসঙ্গতি এবং অপারগতার দিকটিতেও আরও সচেতন সতর্কতা অবলম্বনের অবকাশ বারবার অনুধাবনযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন তথা স্বয়ম্ভরতা অর্জন শুধু ভাব-ভাবনার বিষয় হয়ে থাকলে এবং এ ব্যাপারে বাস্তব ও দৃঢ়চিত্ত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং আবশ্যকতার উপলব্ধি যদি অবহেলা-অমনোযোগিতার হাতে বন্দি থাকে- তা হলে স্বপ্ন দেখাই শুধু সার হবে, ভাব-ভাবনারা বাস্তবতার বাসর পাবে না ও বহিরাগত মত-মন্তব্য শোনা সার হবে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সদাচার আর সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা কারও দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসবে কেন! এসব তো প্রয়োজন অন্তর্নিহিত সহায়ক সলিলাশক্তির পুষ্টিকর প্রবৃদ্ধির জন্য। এখানে পক্ষ-বিপক্ষের কোনো বিষয় নয়- নিজেদের স্বার্থে, সবার স্বার্থে এসবের প্রয়োজন। অবলীলায় আইন অমান্য করে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে, সম্ভাবনা ও সুযোগকে অপব্যয়-অপচয় যাতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যাতায়াত-যোগাযোগ-জনসেবা- সর্বত্র পরিব্যাপ্ত না হয়, এ ব্যাপারে দৃঢ়চিত্ত পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে। ছোট উদাহরণ- ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে মূল্যবান ও কারুকার্য সংবলিত আধুনিক সিগন্যাল বাতি বসানো আছে। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব সিগন্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বাস্তবে দেখা যায়, এগুলোর প্রকৃত ব্যবহার একেবারে নেই। বিপুলসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ তাদের মান্দাতার আমলের উপস্থিতি দিয়ে, সম্পূর্ণ অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ‘নিজের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি ও বিচার’ মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে চলছে। একদিকে ডিজিটাল সিগন্যাল লাইট জ্বলছে আবার এর বিপরীতবলয়ে ট্রাফিকের ম্যানুয়েল (ব্যক্তিগত) কসরতও চলছে। এ অব্যবস্থাপনায় শুধু ট্রাফিক পুলিশের নয়, সড়ক ব্যবহারকারী লাখো মানুষের সহস্র শ্রমঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে। মহার্ঘমূল্যে কেনা ও সংস্থাপিত সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যবহারিক কার্যকারিতা না থাকলেও এগুলো নিয়মিত জ্বলছে, ইনডিকেশন দিয়ে চলছে এবং সেগুলোর সংস্থাপন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিশ্চয় বহন করতে হচ্ছে। এই মশহুর অপচয় ও অপব্যয় একটি মধ্যম আয়ের খায়েশধারী দেশের জন্য ব্যয়বহুল বালসুলভ ব্যবস্থা নয় কি? নিজেরা নিজেদের নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণের ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও দায়িত্বহীন হয়ে পড়ায় ঢাকা মহানগরীর ‘অবাসযোগ্য শহর’ তালিকায় সব শেষের আগের ক্রমিকে জায়গা মিলেছে।
মধ্যম আয়ের অভিলাষী একটি দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আর্থিক ‘অন্তর্ভুক্তি’র দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন- এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু তা শুধু কথার কথায় ঘুরপাক খেয়ে বিকশিত হতে পারে না। অন্তর্ভুক্তির দর্শনকে সার্বিকভাবে টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হলে প্রশাসনিক আর্থসামাজিক পরিবেশ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, দেশজ সংস্কৃতিতে সর্বত্র গোষ্ঠীভুক্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিপরীত পক্ষকে বিচ্যুতকরণ ব্যবস্থাপনার বিবরে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি উন্নয়ন দর্শন যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, এদিকে খেয়াল রাখতে হয়। রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে (ক্ষেত্র, অঞ্চল ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি) বিশেষ প্রাধান্য এবং অন্যায়-অনিয়মে প্রতিকার-প্রতিবিধানের বেলায় পক্ষপাতিত্ব কিংবা অপারগতার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির দর্শন বিকশিত হতে পারে না। বিনা বিনিয়োগ ও শ্রমে অবৈধ আয়-উপার্জনের অবারিত সুযোগে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণে যে দুই-তিনগুণ ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তা তো যে কোনো বিবেচনায় ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস প্রডিউস না হয়েও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়।’ নানা অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত, সরবরাহে বিঘœ, নানা দুর্ঘটনায়, দুর্নীতিতে অস্বচ্ছতায় যে বিপুল অর্থক্ষরণ ঘটে, এতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা কঠিন হচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল, স্বল্প কৃষিজমি, বেকারের ভারে ন্যুব্জ, অতি আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে শ্রমঘননির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী ও প্রযুক্তিবাহী বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ দেশে গত সাড়ে চার দশকে আসা বৈদেশিক বিনিয়োগের স্থিতিপত্র কষলে দেখা যায়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সূত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ততটা আসেনি, যতটা দেশি মুদ্রায় অর্জিত মুনাফা বরং বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে (যেমন- টেলিকম ও ধূমপান সেক্টরে) যাচ্ছে। লক্ষণীয় যে, এ দুটি সেক্টরই রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। দেশে আসেনি বা বিকাশমান হয়নি তেমন কোনো শ্রমঘন শিল্প। বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিকরা যখন অধিক অর্থ ব্যয় করে স্বল্পমজুরিতে বিদেশ গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং দেশে শিক্ষিত বেকারের মিছিল দ্রুত বাড়ছে, তখন এ দেশে স্টেট অব আর্টে চালিত কতিপয় বিদেশি শিল্প (যেমন- সিমেন্ট, সিগারেট, টেলিকম, প্রসাধন, আর্থিক ও শিপিং) গড়ে উঠছে আর গার্মেন্টসহ প্রায় সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মধ্য ও উচ্চপর্যায়ে মোটা বেতনে অধিক বিদেশিদেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশিরা বছরে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার বেতন, পারিশ্রমিক বাবদ নিয়ে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশে রেমিট্যান্স আসছে অধিক অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যাওয়া অদক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে। সেকেন্ড হোম কিংবা মেধা পাচার হয়ে যাওয়া শিক্ষিত, পেশাজীবীদের কাছ থেকে অর্থনীতি তেমন কোনো প্রত্যাবসন পায় না। তারা দেশি পুঁজি বা মুদ্রা বরং বিদেশে নিয়ে যান। আবার দেশে প্রত্যাবাসিত অর্থের টাকা বিনিয়োগ ছাড়া অলস হয়ে পড়ে থাকছে। অলস রিজার্ভের ‘প্রশান্তিবোধ’ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সচেতনতায় শৈথিল্য আনে, ব্যাপক পরিমাণে কঠিন শর্তের বিদেশি ঋণ গ্রহণের আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে ঋণভারে জর্জরিত অনেক সম্ভাবনাময় অর্থনীতি পরবর্তীকালে বিপাকে পড়েছে- এ উদাহরণ আছে।
একটি বৃহৎ দেশ ও অর্থনীতির পেটের মধ্যে ৯২ শতাংশ উন্মুক্ত সীমান্ত পরিবেষ্টিত ছোট একটি দেশের সীমান্তবাণিজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করতেই পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে বহির্বাণিজ্য ইনফরমাল ট্রেড আর অসমর্থিত বাণিজ্য বিনিময়-বিনিয়োগ-তাড়িত-শাসিত-শোষিত। এটি বাস্তবতা। যে কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের উন্নয়ন অভিমুখী অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য পদে পদে আত্মস্বার্থ সচেতন ও চেষ্টিত হওয়ার বিকল্প নেই। উৎসবের অর্থনীতির এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের শুধু প্রাণিসম্পদ আমদানি হলেও এর সিংহভাগ লেনদেন চলে হুন্ডি বা অসমর্থিত ব্যবস্থায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা হলো বাংলাদেশে আমদানিকৃত ওইসব পশুর কাঁচা চামড়া সীমান্ত বিনিময় বাণিজ্যে পাচার হয়ে যায়। নিজস্ব পরিবহনে হজযাত্রীদের পরিবহন করতে না পারায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এ বিষয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকারমুখী সংস্কার ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে পারলে সেটিই হবে বিশ^ব্যাংকের ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ মন্তব্যের উপযুক্ত প্রতিমন্তব্য।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান