প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র (টিএসসি) আমাদের গৌরব। এটি আমাদের আবেগ-অনুভূতির একটি প্রতীক। বহুদিন পর এখানে পদার্পণ করলে, নিজস্ব সহপাঠী সবাইকে সর্বদা খুঁজে না পেলেও পুরনো বন্ধু হিসেবে খ্যাত টিএসসি আমাদের ঠিকই হাতছানি দিয়ে ডেকে নেয়। আমরা বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। পুরনো ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখাই আমাদের ইতিহাস, স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। নগরীর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে খুঁজে নেয় টিএসসির পায়রা চত্বর, মিলন চত্বর কিংবা রাজু ভাস্কর্য। এখন সেসব স্থানে হবে বহুতল ভবন। আগে জাতীয় দিবস, বৈশাখী উৎসব কিংবা জাতীয় দলের ক্রিকেট ম্যাচের সময় সবার গন্তব্য ছিল টিএসসি। কিন্তু টিএসসির ওই স্বরূপ আগের মতো দেখা যাবে কিনা, এ বিষয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে সবাই ঐতিহ্য সংরক্ষণের পক্ষে। আধুনিক করার জন্য সংস্কার জরুরি। বাইরে থেকে অনেকেই টিএসসিতে ঘুরতে আসেন। তবে পুরনো জিনিস তার ঐতিহ্য ধরে রেখেই সংস্কার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন অনেকে। সংস্কার জরুরি। কিন্তু ঐতিহ্য ভেঙে নয়। ঐতিহ্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীবান্ধব টিএসসি আমাদের চাওয়া। তবে কোনোভাবেই ঐতিহ্য যেন ক্ষুণœ না হয়। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু এখন টিএসসি। পক্ষে-বিপক্ষে আসছে নানা মত। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। টিএসসিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য দেশের জনগণ সিদ্ধান্ত ও মতামত দিতে পারে। নানা জায়গা থেকে মতামত আসা উচিত। সব ঐতিহ্য রক্ষা করা প্রয়োজন। গ্রিক স্থপতির করা এই কুঁড়েঘর ডিজাইন আমাদের বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে তৈরি। ঢাবির বেদখল হওয়া জায়গাগুলো পুনরুদ্ধার ও ইতিহাসের অংশ অক্ষুণœ রাখার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। ফ্রান্সে এক হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু কাঠামো ভেঙে ফেলা নয়। শিল্পকলায় ভর করে রাষ্ট্র ও সভ্যতা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিল্পকলা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি জাতির ধারক-বাহক, সভ্য সংস্কৃতির বিকাশে অগ্রগণ্য। টিএসসি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এখন সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে টিএসসি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত নয়। উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় বিকল্প তৈরি হতে পারে। ঐতিহাসিক স্থাপনা একবার ভেঙে ফেললে আর তৈরি হবে না। ঢাবির অনেক প্রকল্প রয়েছে। এসব জায়গায় নতুন ভবন তৈরি হতে পারে।
বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে টিএসসি চত্বরকে আধুনিকায়ন করা হবে। এ জন্য ভেঙে ফেলা হবে এর ভবন। সংস্কারের পর টিএসসিতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে সুযোগ-সুবিধা থাকবে- সেগুলো হলো মহড়া কক্ষ, ব্যায়ামাগার, টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত কক্ষ, আন্তঃক্রীড়া কক্ষ, পৃথক ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক মিলনায়তন, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলাবিশিষ্ট স্থান, অতিথি কক্ষসহ বেশকিছু আধুনিক সুবিধা থাকবে। একটি দেড় হাজার ও ৩০০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মিলনায়তন থাকবে। থাকবে সুইমিংপুল, সবুজ চত্বরে লাল কংক্রিটের ভবন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কুঁড়েঘরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রিক স্থপতির নকশায় তৈরি চিরযৌবনা ওই ভবন চত্বরটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থাপত্যকলার রোল মডেল। নিজস্ব স্বকীয়তায় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবেই পেরিয়ে এসেছে সুদীর্ঘ ৫৬ বছর। ষাটের দশকে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের এই অনুপম নিদর্শন সংস্কৃতিপ্রেমীদের মিলনস্থল। তারুণ্যের এই উঠানে থমকে যাওয়া সময় গল্প শোনায় সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, প্রগতি, সম্ভাবনা ও আশা। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই সূতিকাগার রক্ষণাবেক্ষণের বদলে ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের আয়োজনে ব্যথিত, হতাশ সংস্কৃতিপ্রেমীসহ সাধারণ মানুষ। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভেঙে ফেলার বিরোধিতায় সরব অনেকেই। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কারের দাবি উঠেছে সর্বত্র। টিএসসির ভেতরের খোলাচত্বরে সবুজ ঘাসের পেলব ছোঁয়া। পূর্ব দেয়ালের গা ঘেঁষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলা সমাধিসৌধ। অডিটোরিয়ামের সামনে ম্যুরাল শান্তির পায়রা। রোদ-হাওয়ার দোল খাওয়া অডিটোরিয়ামের খোলা উত্তর-দক্ষিণে পানিশূন্য সুইমিংপুল সাক্ষ্য দেয় অতীত গৌরবের। দক্ষিণের প্রান্তজুড়ে নাটকের মহড়া কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিশালা। তৃতীয় তলার বামপাশে ছাত্র নির্দেশনাকেন্দ্র, বিশ^বিদ্যালয় রোভার স্কাউটের প্রধান কার্যালয়, দোতলায় অফিস, ঢাবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়, পশ্চিমে সেমিনার কক্ষ ও বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়। নিচতলায় জনতা ব্যাংক ও বিশ^বিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার বিপণনকেন্দ্র। ডিবেটিং সোসাইটি, নাট্যসংসদ, চলচ্চিত্র সংসদ, মাইম অ্যাকশন, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, জয়ধ্বনি, প্রভাতফেরি, আইটি সোসাইটি, স্লোগান ’৭১, সায়েন্স সোসাইটি, আবৃত্তি সংসদসহ সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু টিএসসি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিএসসির সামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য অপরিসীম। পৃথিবীর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ছবি দেখেই চেনা যায় কিছু ঐতিহ্য ধারণ করা স্থাপনার মাধ্যমে। শত শত বছরের পুরনো হয়ে গেলেও এগুলোকে সযতেœ সংরক্ষণ করা হয়। ঢাবির এমন স্থাপনার মধ্যে আছে কার্জন হল, এসএম হল ও টিএসসি। এর মধ্যে টিএসসি ষাটের দশকে নির্মিত অপেক্ষাকৃত আধুনিক স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ববর্তী সময়ে ঢাবির সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ঐতিহ্য ধারণ করে এই টিএসসি। এদিকে শিক্ষকদের কেউ কেউ টিএসসির দৃষ্টিনন্দন ভবনটি ভেঙে ফেলা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কেবল বহুতল ভবন নির্মাণই একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে পারে না, সাংস্কৃতিক উন্নয়নও সেখানে সমানভাবে ভূমিকা রাখে। টিএসসি চত্বরে সব সময়ই বিশাল মাঠ ও খোলাজায়গা রয়েছে। কিন্তু নতুন পরিকল্পনায় টিএসসির প্রকৃতি ও প্রাণের স্পন্দন যেন হারিয়ে না যায়। কৃত্রিমতার চাপে সাংস্কৃতিক উদারতা যেন বহাল থাকে। এ টিএসসি চত্বর কেবলই একটি বিনোদনকেন্দ্র নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র। পৃথিবীর বিবর্তনে সবচেয়ে শক্তিশালী অলিখিত ইতিহাস হচ্ছে স্থাপত্য। ঢাবি ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রের পূর্বদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। তা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলার প্রাণের গ্রন্থমেলার অনবদ্য ঠিকানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিতে এর গুরুত্ব আমরা সবাই জানি। দক্ষিণে বাংলা একাডেমি, আরও দক্ষিণে মোগল স্থাপনা, ঢাকার প্রবেশদ্বারখ্যাত মীর জুমলার তোরণ বা রমনা গেট, এর উল্টো পাশে তিন নেতার মাজার। কিছুদূর গেলেই দোয়েল চত্বর। এটি ঘিরে আছে শিশু একাডেমি আর কার্জন হল। কার্জন হল থেকে পশ্চিমে শহীদ মিনার। আর ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রের উত্তরে আছে শাহবাগ। এটিকে বলা চলে নাগরিকের কথা বলার একমাত্র মঞ্চ। এবার চোখটি বন্ধ করে ভাবেন, এসব কিছুর নিউক্লিয়াস হলো এই ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র। নাগরিক মননে এই স্থাপনা যে অবয়ব তৈরি করে রেখেছে, তা প্রাচীন। এই সম্পর্ক আত্মার। তা স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও সবার কাছে এক রকম। আমরা উন্নয়নের পক্ষে। আমরা অবশ্যই চাই দেশের সবচেয়ে পুরনো আর ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধি পাক। কিন্তু ইতিহাস বিসর্জন দিয়ে নয়। টিএসসি ঐতিহাসিক জায়গা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উজ্জ্বল অতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যার সমাধান করে, গবেষণার বরাদ্দ বাড়িয়ে, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই রেখে এবং সেটিকে অনলাইনে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। হলগুলোয় আবাসন সমস্যার সমাধান করতে হবে।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপনের আগেই টিএসসি চত্বরের উন্নয়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। টিএসসি এক অনিশ্চিত দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বিংশ শতকে নির্মিত এ স্থাপত্যটি অচিরেই ভেঙে একটি আধুনিক ভবনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মূলত ২০২১ সালে ঢাবির শতবর্ষপূর্তি উদযাপনের আগেই এটি করার সিদ্ধান্ত। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), টিএসসি ও শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিকে আধুনিকীকরণের কাজে এগিয়ে আসে। ঢামেকসহ অন্যান্য ভবন আধুনিকায়নের পরিকল্পনা অনেকখানি এগিয়ে গেলেও টিএসসি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টিএসসির আধুনিকায়নের জন্য যথাযথ নকশা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রিক স্থপতি ও পরিকল্পনাকারী কনস্টান্টিন অ্যাপোস্টলোস ডক্সিয়াডেস ১৯৬০ সালের শুরুতে টিএসসির নকশা করেন। পরে টিএসসি ভবনটি তৎকালীন জেনারেল আইয়ুব খানের পাকিস্তানি সামরিক সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের দশকের (১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল) অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বছরের পর বছর প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয় গণরুমে। ছাত্রছাত্রীদের ভালোভাবে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হল নির্মাণ করতে হবে। মানবেতর পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা নিশ্চিত করার পশাপাশি এমন একটি ঐতিহাসিক ভবনের ঐতিহ্য বজায় রেখে টিএসসির উন্নয়ন করা যেতে পারে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিমত ব্যক্ত করেন। টিএসসির ঐতিহ্যবাহী এই স্মৃতিময় পুরনো ভবন রেখে ঢাবির অতীত ঐতিহ্য-ইতিহাসকে বিনষ্ট না করে বাস্তবতার নিরিখে টিএসসির আধুনিকায়ন করা যেতে পারে।
সৈয়দ ফারুক হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়