আমেরিকার বিখ্যাত লেখক, অধ্যাপক ডেল কার্নেগির একটি স্মরণীয় উক্তি ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।’ অনেক সময়ই আমরা আমাদের মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না। যে কোনো কারণেই হোক মেজাজ খারাপ হতেই পারে। ঘুম থেকে উঠে, খাবারের টেবিলে, অফিসে কাজ করতে গিয়ে কিংবা কারও ফোন পেয়ে মেজাজ খারাপ হতেই পারে। রাগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর প্রকাশের ভঙ্গিও আবার আলাদা। রাগ হলে কেউ হয়তো উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে কথা বলেন। আবার কেউ জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলেন। আবার কেউ কেউ রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলেন। অনেকে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। পরে পরিস্থিতি ঠা-া হলে বুঝতে পারেন যে, তিনি কতটা ভুল করে বসেছেন যা হয়তো পরে আর শুধরানোর সুযোগ থাকে না। সম্পর্কটাই হয়তো চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যায়।
অনেকে বলে থাকেন, রাগের বশে ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু যে ভুলটি হয়ে গেছে তার জন্য শুধু অপরপক্ষই কষ্ট পায় না, তিনি নিজেও কষ্ট পেতে থাকেন। এক সময় হয়তো সব ঠিক হয়ে যায় কিন্তু রাগের মাথায় ভুল সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় সারাজীবন ভোগায় কিংবা কঠিনভাবে এর মাসুল দিতে হয়। একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করা যেতে পারে। অফিসের এক কর্মকর্তা বসের কাছে ঝাড়ি খেয়ে রাগটা ঝেড়ে দিলেন এক কর্মচারীর ওপর। কর্মচারী বেচারা তার জমা রাগটা বাসায় গিয়ে ঝেড়ে দিলেন স্ত্রীর ওপর। স্ত্রী সে রাগটা ঝেড়ে দিল তার সন্তানের ওপর। সন্তান সামনে এক বিড়াল পেয়ে সজোরে লাথি মারতেই বিড়াল দৌড়ে পালাল। আর অমনি লাথি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দরজায় প্রচ- আঘাত হানল। ফলে সন্তানের পা ফ্রেকচার এবং হসপিটালের বিছানায় কয়েক মাস সটান শুয়ে থাকা। এটাই হলো রাগের মাসুল।
কোনো মানুষ রেগে গেলে রাগকে প্রশমিত করার জন্য অনেকেই অনেক ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেকেই বলেন, মনে মনে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনুন। রাগ কমে যাবে। আবার অনেকেই বলেন, রাগের সময় এক গ্লাস পানি পান করুন। রাগ চলে যাবে। কেউ কেউ বলেন, কারও জন্য ভালো কিছু করুন। রাগ পড়ে যাবে। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠবে। তবে আমি মনে করি, রাগের নিয়ন্ত্রণটা সম্পূর্ণরূপে নিজের কাছে। একে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্ত থাকা যাবে তা বিবেকবোধই যথাসময়ে বলে দেবে। রাগ দিয়েই যদি সবকিছু জয় করা যেত তা হলে তো রাগেরই জয় হতো, ভালোবাসার জয় হতো না।
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবন থেকে আমরা দেখেছি তারা রাগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাদের জন্য এমনই একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন একটি কালজয়ী ব্যক্তিত্বের নাম। লিংকনের বাবা মূলত জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এ পেশার আয় থেকেই তিনি সংসার চালাতেন। কখনো কখনো লিংকন নিজেও বাবার কাজে হাত লাগাতেন। একবার কোনো এক অনুষ্ঠানে লিংকন বক্তৃতা দিতে শুরু করলে, এক প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, আপনি একজন মুচির ছেলে। এ কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল এবং ভাবল এবার নিশ্চয়ই লিংকন রেগে আগুন হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় তার রাগ বরং হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, আমার বাবা জুতা সেলাই করতেন, তাকে নিয়ে আমি গর্বিত। আমিও জুতা সেলাই করতে পারি। আপনার প্রয়োজন হলে আমি সেলাই করে দেব। সবাই মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনলেন এবং মনে মনে ভাবলেন, এই না হলে দেশটির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট!!! কাজেই আসুন রাগ দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে জয় করি যার স্থায়িত্ব হবে অনাদিকাল।
ড. ইউসুফ খান : প্রাবন্ধিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক