কোভিড-১৯ গোটা জাতিকে নতুন করে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে গেল। এমন দুর্যোগকালে বলাই বাহুল্য যে, পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা, সহমর্মিতা তথা মানবিকতার নতুন করে অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। একইভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের ভোগান্তিকে পুঁজি করে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার নেশাতেও বিভোর হয়ে পড়ে একশ্রেণির লোক। তবে স্বস্তি ও আশার কথা যে, শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপী করোনার ব্যাপ্তি-বিস্তার ও তা-বনৃত্য দেখে দেশে যে পরিমাণে প্রাণক্ষয় ও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া গেছে। কিছু চুরি-চামারি, প্রতারণা, গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতা থাকলেও সার্বিকভাবে আতঙ্কজনক এ ধকলটিকে সামাল দেওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও যুগোপযোগী উদ্যোগ এবং কর্মপ্রয়াস বেশ প্রশংসনীয়।
করোনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অবজ্ঞা আর অবহেলার চিত্রটিও নতুন করে উন্মোচিত হয়ে যায়। পাবলিক পরীক্ষা মানেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু থেকে একেবারে ফল প্রকাশ পর্যন্ত। কেবল পরীক্ষার্থী নয়, অভিভাবকদের জন্যও। করোনায় তাড়িত হয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ল-ভ-। শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত। একটি বছর বলতে গেলে মাটি। এমন দুর্বিষহ বাস্তবতায় করার কিছু ছিল না।
গত ৭ অক্টোবর জানানো হয়, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। কথা ছিল নীতিমালার ভিত্তিতে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশের। শুরু হয় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অপেক্ষার পালা। কিন্তু হয়, হচ্ছে করেও তা হলো না। প্রয়োজনীয় আইন করতেই প্রায় চারটি মাস লেগে যায়।
মরণব্যাধি করোনার ভয়াল থাবায় টানা এক বছর বন্ধ থাকার পর ৩০ মার্চ খুলছে দেশের সব স্কুল-কলেজ। তাও কতটা নিশ্চিত, তা সময়েরই ব্যাপার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার এমন ঘোষণা এর আগে দফায় দফায় অনেকবারই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পারায় দিন-তারিখ বারবার পেছাতে হয়েছে। অনিবার্য ক্ষতি অনেক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর আবার কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাও বলা মুশকিল। এ জন্য সবাইকে সবদিক থেকেই সজাগ থাকতে হবে। স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণায় আছে এক. পঞ্চম শ্রেণি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা আসবে সপ্তাহে ছয় দিন, দুই. নবম ও একাদশ শ্রণির শিক্ষার্থীরা আসবে দুই দিন, তিন. অন্যান্য শ্রেণিতে সপ্তাহে আসতে হবে একদিন, চার. প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি আপাতত খুলছে না এবং পাঁচ. রোজাতেও খোলা থাকবে স্কুল-কলেজ। নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী উদ্যোগ। তবে যে যাই বলুন, আমাদের মতো একটি দেশে উল্লিখিত নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা চালিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন এক কাজ।
করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগে শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুন্দর, সুষ্ঠু আর সুশৃঙ্খল তো নয়ই- অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষায় কাক্সিক্ষত ন্যূনতম পরিবেশটিও ছিল না। কমিটির সভাপতি বা সদস্যদের দৌরাত্ম্য, অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের লোভ-লালসা ও অদক্ষতা, শিক্ষকদের অযোগ্যতা এবং পাঠদানে অমনোযোগ, মামলা-মোকদ্দমা-হয়রানি, সমস্যা ও ঘাটতি-সীমাবদ্ধতার কোনো শেষ নেই। কারণে-অকারণে সাধারণ শিক্ষকদের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং স্থান ও প্রতিষ্ঠানবিশেষে রয়েছে লাগামহীন কর্তৃত্বপরায়ণতা।
স্বার্থপররা বসে নেই। বসে থাকতে পারে না। করোনার মারাত্মক পরিস্থিতিতেও একশ্রেণির লোক সরকার নির্দেশিত অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্টের অজুহাত দেখিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ছেড়েছে। তারা এমন অবিবেচক ও নির্লজ্জ যে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ বা জানাজানির পর চাপে পড়ে সংগৃহীত অতিরিক্ত টাকা আবার ফেরতও দিয়েছে! দেশের অনেক জায়গায়, অনেক প্রতিষ্ঠানে এমন হয়েছে। অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের মনে থাকার কথা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ মাস বন্ধ থাকার পর স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হয়। স্কুলে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অটোপ্রমোশন দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেবাস অর্ধেকে কমিয়ে এনে পরীক্ষার হলে বসানো হলো। কিন্তু স্বাধীন দেশে অনুষ্ঠিত একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় নকলের কী তা-ব! এমনটাই যদি হবে কিংবা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা হলে বিষয়-পত্র-নম্বর কমানো হলো কেন?
কেবল আগামী পাবলিক পরীক্ষা নয়, প্রতিষ্ঠান খোলার পর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটাই হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পুরোটাই নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের দৃঢ়তা, সদিচ্ছা ও কর্মদক্ষতার ওপর। আর শিক্ষা বিভাগ তথা মন্ত্রণালয়ের সঠিক নজরদারির বিষয়টি তো রয়েছেই। খুব কঠিন কাজ। লক্ষ্য একটিই- বিরাজমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতে পারে।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক