দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানববিকাশের অন্যতম এবং অত্যাবশ্যকীয় উপাদান মানসিক স্বাস্থ্য। বৈশ্বিক নানা সমস্যার কারণে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মানসিক সমস্যা ও মানসিক বৈকল্যের প্রাবল্য দেখা দিয়েছে। এর প্রধান শিকার কিশোর ও কিশোরীরা। এসব সমস্যা সব সময় জাতীয় উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে। এক সময় বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতার অভাব দেখা গিয়েছিল। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যে শরীরবৃত্তীয় যোগাযোগ রয়েছে, তা রীতিমতো অবহেলিত ছিল। তবে বর্তমানে শরীরবৃত্তীয়, সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সমন্বয়ে সার্বিক স্বাস্থ্য ধারণার বিকাশ ঘটেছে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য আর আগের মতো অবহেলিত বিষয় নয়, বিশেষ করে কিশোর ও কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য। কিশোর ও কিশোরীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যদি মানসিক স্বাস্থ্যও সুস্থ থাকে, তা হলে তারা-
১. প্রতিদিনের কাজকর্ম সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারে। ২. যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহসী হতে পারে। ৩. পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজেদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে।
৪. মানসিক দৃঢ়তা থাকলে খুব দ্রুত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ৫. নিজের ও সমাজের উন্নয়নে অগ্রসর ভূমিকা রাখতে পারে। ৬. সব বিষয়ে ইতিবাচক মানসিকতার সব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে। ৭. মানুষের প্রতি সদয় ও শ্রদ্ধাশীল থাকে। ৮. নিজকর্মে মনোযোগী থাকে।
কৈশোর বা তারুণ্য জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ সময় ছেলেরা বাবা হওয়া ও মেয়েরা মা হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এ সময় তাদের মানসিক বিকাশের বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। মা, বাবা, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সবাইকে কিশোর-কিশোরীর মনোবিকাশে যত্নশীল হতে হয়। এ সময় শরীর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মনোজাগতিক জটিলতা দেখা দেয়। কখনো অনেক কথায় কিছু মনে করে না আবার কখনো অল্প কথায় রেগে ওঠে। এ সময় তারা অজানা বিষয়ের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে, সব বিষয়েই কৌতূহলী হয়। অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়। সামান্য কারণে কখনো নিজের ক্ষতি করে ফেলে অথবা আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় তাদের মাঝে ওফবহঃরঃু পৎরংরং তৈরি হয়। দ্বন্দ্বে থাকে যে তারা আসলে বড়, না ছোট। কেউ কেউ বিষণœতাতেও ভোগে।
এ বয়েসে নানা বিষয়ে মা-বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পড়ালেখা, বন্ধু নির্বাচন, নির্দিষ্ট রুটিনে না থাকা, হাত খরচ, জীবনের লক্ষ্য নির্বাচন ইত্যাদিই দ্বন্দ্বের কারণ। তা ছাড়া নিজের ব্যক্তিত্ব, কিছু সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা না থাকা, সহজে রেগে যাওয়া অথবা মা-বাবার সন্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ার সমস্যা, মনোদৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা, প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা, মা-বাবার নিজস্ব শারীরিক বা মানসিক সমস্যা, মা-বাবার মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সময় দিতে না পারা অথবা মা-বাবার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সন্তানকে ওই পথে পরিচালনা করার ইচ্ছার কারণে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তবে অনেক সমস্যার মতো এ সমস্যারও সমাধান আছে। এটি শুরু করতে হবে ঘর থেকে। এ জন্য কিশোর-কিশোরীদের সবার আগে মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ ও এর স্বাভাবিকতা সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা দিতে হবে। পড়াশোনায় সামর্থ্য নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনা করে তার অর্জিত ফল নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে অযথা চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। মনে রাখতে হবে পরিবেশ, সামাজিক ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, অসহায়ক পরিবেশে বেড়ে ওঠার ওপর কারও এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে যাওয়া নির্ভর করে। যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, কখনো শারীরিক শাস্তি দেওয়া যাবে না। এটি শুধু নিষ্ঠুর অমানবিকতাই নয়, কিশোর-কিশোরীর মনোবিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। ভুলগুলো তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে এবং কীভাবে এটি থেকে মুক্ত হওয়া যায়, এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
কিশোর-কিশোরীদের সব সময় পারিবারিক কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা দরকার। এতে তার মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে। পরিবারে নিজের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হবে। মনে রাখা দরকার, সাধারণভাবে সন্তানরা মা-বাবাকে অনুসরণ করে। তাই সন্তানের মনোজাগতিক বিকাশের জন্য নিজেদেরও সচেতনভাবে সদাচরণ করতে হবে। আমরা জানি- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এ যৌক্তিক বাক্যটিকে সামনে রেখে বলতে পারি- একটা বিশাল অট্টালিকা দাঁড় করানোর জন্য যেমন মজবুত ভিত্তি দরকার, একটা বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যেমন দরকার অসংখ্য শিকড়, তেমনি একজন মানুষকে সঠিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য দরকার শিক্ষা। এ শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যেহেতু কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ঘুমিয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষক ও রূপকার, সেহেতু শিশুকে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে তুলতে হবে। এটি সম্ভব পাঠ্যপুস্তক পাঠের পাশাপাশি তাকে অন্যান্য বই পাঠেও আগ্রহী করে তুলতে হবে। তা ছাড়া তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে-
নিজের যত্ন নিতে হবে : মানসিক সুস্থতা ও সুস্থ ভাবাবেগ পেতে নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়। নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা করে রাখতে হয়। নিজের মনের কথা শুনতে হয়। অবসরে পছন্দের গান শুনতে হয়, পছন্দের বই পড়তে হয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা না করে বর্তমান নিয়ে ভাবলে হতাশা বা ভীতি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ করতে হবে : পুষ্টিকর খাবার কেবল আমাদের শরীরকেই নয়, মনকেও ভালো রাখে। কখনো কখনো অস্বাস্থ্যকর খাবার মানসিক বিষণœতারও কারণ হয়। ভিটামিন বি-১২, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া তাজা ফলমূল ও সবজি একটা বড় ভূমিকা রাখে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে। পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শারীরিক ও মানসিক- উভয় স্বাস্থ্যই সুস্থ থাকে।
দরকার পর্যাপ্ত ঘুম : আজকাল বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী রাত জেগে পড়াশোনা কিংবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে- শরীর সুস্থ রাখতে যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই, তেমনি মনকে সুস্থ রাখতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। ফলে যে কোনো কাজ করার সময় সহজেই ক্লান্তি আসে, কর্মস্পৃহাও কমে যায়। তা ছাড়া ঘুমের বিশাল কাজ হলো শরীর ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো সারিয়ে তোলা। শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
নিয়মিত খেলাধুলা কিংবা শরীরচর্চা : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কখনো কখনো মাঠের অভাবে আজকাল অনেক কিশোর-কিশোরী খেলাধুলা করতে পারে না। আবার কেউ কেউ অন্য আনন্দে ব্যস্ত থাকে বলে খেলাধুলা করতে চায় না। বুঝিয়ে বলতে হবে, মানসিকভাবে ভালো থাকতে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটাও জরুরি। শরীরকে সক্রিয় রাখতে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে সুখ হরমোন নিঃসৃত হয়। মানসিকভাবে হালকা বোধ করতে বা মন ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের চর্চা করতে হবে।
কিছু সময়ের জন্য মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকা : আজকাল মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। এটি অন্য কিছু থেকে মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেয়। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যতটা সম্ভব যন্ত্রের ব্যবহার সীমিত করা দরকার। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে মোবাইল ফোনসহ যন্ত্র ব্যবহার বাদ দিতে হবে। এমনকি দিনের বেলাতেও যন্ত্র যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। সাধারণত এসব বিষয়ে সহজেই তারা মনোযোগী হতে চায় না। নানা যুক্তিতর্ক কিংবা ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। এ জন্য পরিবারের সবাইকে অসীম ধৈর্যধারণ করতে হবে। তা ছাড়া এ বয়সে সবচেয়ে বেশি এবং সবার আগে দরকার প্রাণভরা ভালোবাসা। ভালোবাসলেই সংসারে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। আর কিশোর-কিশোরীরা তো নরম মাটি। তাদের ভালোবেসে সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে সহায়তা করা সম্ভব।
শেলী সেনগুপ্তা : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক