কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর গত ছয় মাসে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, স্মৃতিভ্রংশ, মানসিক রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে যারা কোভিড আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে মানসিক এবং মস্তিষ্কের নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল কিংবা আইসিইউতে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ লাখের বেশি রোগীর ইলেকট্রনিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন, কোভিড আক্রান্ত রোগীরা পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, স্মৃতিভ্রংশ, স্নায়ুরোগ, গুরুতর মানসিক অসুস্থতা সাইকোসিস, উদ্বেগ, অবসাদের মতো রোগের শিকার হতে পারে। বিশেষ করে মানসিক অবসাদ এবং যে কোনো কিছু নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়গুলো কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, কোভিড আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাদের ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ, অস্বস্তি এবং ভয় তৈরি হয়। অন্যদিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকির বিষয়টি নির্ভর করছে ভাইরাসের প্রতি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার ওপর। যদিও এ গবেষণাটি পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। সুতরাং গবেষকরা বলতে পারছেন না কোভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে এসব হয়েছে কিনা। কারণ কিছু মানুষ হয়তো পরবর্তী ছয় মাসে এমনিতেই স্ট্রোক অথবা অবসাদে আক্রান্ত হতো।
যারা কোভিড আক্রান্ত হয়েছিল তাদের সঙ্গে অন্য দুটি গ্রুপের একটি তুলনা করেছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। অন্য দুটি গ্রুপ হচ্ছে- ফ্লুতে আক্রান্ত এবং অন্যটি হচ্ছে অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যা আছে এমন ব্যক্তিরা। পরবর্তী সময়ে গবেষকরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন যে, কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যা না হয়ে মস্তিষ্কজনিত সমস্যা হতে পারে। গবেষণার জন্য যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্যগত অবস্থা এসব কিছু বিবেচনা করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ১৬ শতাংশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল। যেসব কোভিড আক্রান্ত রোগীর অবস্থা যত বেশি খারাপ ছিল, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যা এবং ব্রেন ডিসঅর্ডার তত বেশি তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ২৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে এটি ২৫ শতাংশ।
একইভাবে কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে ২ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু যারা আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়েছে তাদের মধ্যে ৭ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে রোগীদের মধ্যে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশের ক্ষেত্রে স্মৃতিভ্রংশের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর যাদের ক্ষেত্রে আগে থেকেই মস্তিষ্কজনিত সমস্যা ছিল তাদের মধ্যে ৫ শতাংশ স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত হয়েছে। আলঝেইমার্স রিসার্চ ইউকের প্রধান গবেষক ড. সারা ইমারিসিয়ো বলেন, আগের গবেষণাগুলোয় দেখার চেষ্টা হয়েছিল যে যারা মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ আলঝেইমার্স রোগে ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। সর্বশেষ এই গবেষণায় দেখার চেষ্টা হয়েছে, এটি উল্টোভাবে হয় কিনা। অর্থাৎ কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর আলঝেইমার্স রোগের ঝুঁকি বাড়ে কিনা।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোলজির অধ্যাপক মাসুদ হোসেইন বলেন, এমন প্রমাণ রয়েছে যে করোনা ভাইরাস সরাসরি মস্তিষ্কে ঢোকে এবং ক্ষতি করে। এর পরোক্ষ প্রভাবও থাকতে পারে। যেমন রক্ত জমাট বাঁধা, যার ফলে স্ট্রোক হতে পারে। আবার লন্ডনের কিংস কলেজের ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি, সাইকোলজি অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ডেইম টিল ওয়াইকেস বলেন, আমাদের সন্দেহ ছিল কোভিড-১৯ শুধু শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যা নয়। এই রোগ মানসিক এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নতুন গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। খবর বিবিসির।