এক বছর আগে বৈশি^ক করোনা মহামারী শুরু হলে পুরো পৃথিবীর মানুষই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নেমে আসে মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যুর পরিসংখ্যান ততটা বড় না হলেও করোনার ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশের মানুষ। করোনার আকস্মিক আঘাতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাটি সামনে চলে আসে। উন্মোচিত হয় স্বাস্থ্য বিভাগের ভয়ানক দুর্নীতির চিত্র। তার পরও সরকারের দৃঢ়তায় অনেকটা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। করোনা পুরো পৃথিবীর জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। তাই চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিদরা সুনির্দিষ্ট প্রতিবিধানও দিতে পারছিলেন না। সাধারণ মানুষও ছিল বিভ্রান্ত। এর পরও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট আলাদা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও এবং না খেতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে গেলেও শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কম নয়। তাদের অনেককেই শ্রম দিয়ে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী স্বল্পপুঁজি নিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকেন। করোনাকালে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া প্রত্যেকের চাকরি ছিল হুমকির মুখে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অমন বাস্তবতায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনে সবাইকে ঘরবন্দি করে রাখাটা কঠিন ছিল। মহামারীর মৃত্যুভীতির চেয়েও ক্ষুধা আরও ভয়ঙ্কর। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকার কারণে সম্ভবত সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনা প্রবলভাবে ছড়ায়নি। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যাপারে অনেকটা কড়াকড়ি ছিল। এসব কারণেই সম্ভবত গত বছরের শেষ দিক থেকে এ বছর জানুয়ারি পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটা কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হতে থাকে করোনা বোধহয় এ দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। মানুষ জীবনযাত্রা অনেকটা স্বাভাবিক করে ফেলে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেও সতর্কতা কমে আসে। এমন এক বাস্তবতায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। প্রতিদিন হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমণ আর মৃত্যুর সংখ্যা।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বোধহয় অনেকটা ধাতস্ত হয়ে গেছে। কোভিড ভয়ঙ্কররূপে আঘাত হানলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের গাছাড়া ভাব। সম্ভবত সংক্রমণ ছড়ানোর পেছনে এর প্রভাব থাকতে পারে। এর মধ্যে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। কেউ কেউ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। তবে জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য সংখ্যক মানুষই এখন পর্যন্ত টিকা পেয়েছে। তা দেখে মনে হচ্ছে- সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন যে, করোনা আর তাদের ঘাড়ে দাঁত বসাতে পারবে না।
এই হঠাৎ সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অসহায়ত্ব আবার প্রকাশিত হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা থাকলেও বোঝা গেল স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি অপ্রতুল ছিল। বোঝা গেল করোনা রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া এবং আইসিইউয়ের ব্যবস্থাপনায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। অনেক রোগী অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। এমন এক বাস্তবতায় সরকার এক সপ্তাহের একটি বিশেষ লকডাউনের ঘোষণা দেয়।
শুরুতেই দেখা গেছে, করোনার আকস্মিকতায় সরকার ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি দিশাহারা ভাব ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল ভীষণ রকম দোদুল্যমানতা। খেটে খাওয়া মানুষের পেছনেও সরকার খুব বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারি প্রণোদনার অর্থ বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বড় উদ্যোক্তাদের কাছেই চলে গেছে। দলীয় দুর্নীতিবাজরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা পুঁজি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। অনেকেই অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার একাধিক তারিখও ঘোষিত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে করোনার দ্বিতীয় আঘাতের পর অনন্যোপায় হয়ে সরকার সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করে। আমাদের মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এ ধারার লকডাউন কার্যকর করা কঠিন হবে। যদিও জীবন রক্ষার দায় সবচেয়ে বেশি, তবুও জীবিকা সুরক্ষিত না হলে কোনো শাসনই যে কাজে লাগবে না- তা নীতিনির্ধারকদের ভাবা প্রয়োজন ছিল। লকডাউন ঘোষণা করে যখন গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পাশাপাশি অফিস-আদালত, মিল-কারখার খোলা থাকে- তখন বোঝা যায় এমন লকডাউন কার্যকর করা সহজ নয়।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের মুশকিল হচ্ছে, বড় সংকটে খুব তাড়াতাড়ি দিশাহারা হয়ে যান। লকডাউন ঘোষণার আগে গণপরিবহনে ৫০ শতাংশ সিট ফাঁকা রাখার ঘোষণা এলো। স্বাস্থ্যবিধি মান্য করার জন্য এর প্রয়োজন ছিল। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য গণপরিবহনের মালিকপক্ষ ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানাল। রাতারাতি তা মেনে নিল সরকার। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সরকারপক্ষ কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখল না। জানা কথা, এ দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে নৈতিকতাবোধ- এতে ৫০ শতাংশ সিট খালি রাখার চুক্তি সর্বত্র বাস্তবায়িত হবে না। যাত্রীর কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে শতভাগ বাড়তি ভাড়া নিয়ে নেবে। এর কোনো প্রতিবিধান থাকবে না। ৫০ শতাংশ সিট খালি রাখলে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখা হলো না। যেহেতু অফিস আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা, সেহেতু নিত্যদিনের যাত্রীদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার উপায় রইল না। একটি বাস এলে যেভাবে হুড়াহুড়ি করে ওঠার প্রতিযোগিতায় নামেন যাত্রীরা, এতে স্বাস্থ্যবিধি মানার সুযোগ থাকে না। এমন বাস্তবতায় এলো এক সপ্তাহের লকডাউন। এটি ঘোষণার পর পরই একটি সমালোচনা চলতে থাকে। কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা কমপক্ষে দুই সপ্তাহের। তা হলে এক সপ্তাহের লকডাউন কেন! ধরে নিচ্ছি আবার ঘোষণায় বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু লকডাউনের সুফল পেতে হলে সবাইকে ঘরে অবরুদ্ধ থাকতে হবে। এই লকডাউনে শুধু গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হলো। বন্ধ করা হলো মোটরসাইকেলের রাইড শেয়ারিং। চলতে থাকল পণ্যবাহী গাড়ি আর মানুষের ব্যক্তিগত ও অফিসের গাড়ি। শহর লোকারণ্যই থেকে গেল। অফিস-আদালত ঠিকই খোলা রইল। সংবাদমাধ্যমে অফিসযাত্রীদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অতঃপর সরকার নমনীয় হলো। সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো গণপরিবহন চালুর। ওষুধ আর জরুরি খাদ্যসামগ্রীর দোকান ছাড়া সব বিপণি বিতান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো। এর প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকলেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছর করোনার ধাক্কায় ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে পুঁজি হারিয়েছিলেন। এবার ঋণ করে, জমিজমা বেঁচে অনেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। বছরে সবচেয়ে বড় ব্যবসা রোজার এক মাস আগে থেকে ঈদ পর্যন্ত। অর্থাৎ নববর্ষ ও ঈদ সামনে রেখে। এ সময়েই এলো করোনার খড়গ। লকডাউন ঘোষণার আগে এসব জরুরি বিষয় ভাবা হলো না। এটি ঠিক, জীবন সংকটাপন্ন হলে জীবন রক্ষার চিন্তাটিই সবার আগে ভাবতে হয়। কিন্তু জীবিকা যখন ধ্বংসের মুখে, তখন করোনাভীতি মানুষকে আটকে রাখতে পারবে না। এসব কারণেই চারদিকে বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিল বড় হচ্ছে। তাই বোঝাই যায়, এ দেশে লকডাউন কার্যকর করা খুব সহজ নয়। নীতিনির্ধারকরা এসব অগ্রপশ্চাৎ ভেবে সিদ্ধান্তে এলে ভালো করতেন।
তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের আরেকটি সমস্যা ছিল সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা দেওয়া। প্রথমত, এর তেমন প্রয়োজন ছিল না এবং তা কার্যকর করা আমাদের দেশের বাস্তবতায় সহজও নয়। সারাদেশেই করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক নয়। যে জেলা বা শহরগুলোয় কোভিড নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেসব জায়গায় এক সপ্তাহ নয়- প্রয়োজনে এক মাসের কঠিন লকডাউন আরোপ করা উচিত ছিল। প্রয়োজনে কারফিউ দিয়ে হলেও মানুষকে আটকে রাখা উচিত ছিল ঘরে। এ ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রয়োজন বিবেচনায় পরিবারগুলোর এক মাসের খাদ্যসামগ্রী আগেই পৌঁছে দেওয়া।
আমাদের বাস্তবতায় আমরা দুটি বিকল্পই দেখতে পাচ্ছি। পরিস্থিতি যদি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে, তা হলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার বদলে মানুষের জীবন রক্ষাকে প্রধান ভাবতে হবে। মানুষের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তার জন্য বিপুল বাজেট নিশ্চিত এবং তা বিতরণে দুর্নীতি ও দলীয় আনুকূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এর পরই সম্ভব মানুষকে ঘরে আটকে রাখা। দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিতভাবে খুলে দেওয়া।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। এতদিনে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়াটা আমরা শিখে ফেলেছি। শুধু সারাদেশে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট নিরবচ্ছিন্নভাবে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। আর মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে, বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাধীন বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাওয়ার। অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা নিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও চলবে নিয়ন্ত্রিতভাবে। পর্যাপ্ত বাস-লঞ্চের ব্যবস্থা রেখে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করে চলা নিশ্চিত করতে হবে। তবে মুখের কথায় তা কার্যকর করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি প্রয়োজনে বিজিবি, সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবাই শক্ত অবস্থানে থাকলে মাস্ক পরে থাকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানানো খুব কঠিন হবে বলে আমাদের মনে হয় না।
সবকিছুর পরও আমরা বলব, সাধারণ মানুষকে নিজের মতো করেই প্রকৃত অবস্থা বুঝতে হবে। নিজের বা পরিবারের কারও করোনা হয়নি বলে নিজেদের নিরাপদ ভাবা যাবে না। নিজেদের অসতর্কতায় নিজের, পরিবারের, সমাজের ও দেশের ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা মাস্ক পরুন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়