দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা ভাইরাসে মৃত্যু বেড়েছে ৭১ শতাংশ। আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৫তম সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে অর্ধেক জনবল দিয়ে অফিস পরিচালনা করা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করা ইত্যাদি। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এগুলো অন্যতম পদ্ধতি। যেহেতু ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে তা কার্যকর করা যাচ্ছিল না, সেহেতু লকডাউনে যেতে হলো। মূল উদ্দেশ্য হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় সময়ে সময়ে পরিকল্পনা হালনাগাদ করা প্রয়োজন।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাইয়ে। ওই সময়টায়, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতেন। এর পর কয়েক মাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর এক মাসের বেশি ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী। করোনার এই নতুন ধরনের সংক্রমণ হার আগের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি আর জটিলতা বেশি ৩০ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, শিশুরাও এখন নিরাপদ নয়। আগে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি কম আর হলেও খুব সামান্য জটিলতা আছে। ইদানীং দেখা গেছে, শিশুরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এবারের ঢেউয়ে শিশুরা ব্যাপক সংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচাতে এখনই সতর্ক হতে হবে।
এবার করোনায় প্রচুর সংখ্যক শিশু ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা ও বমি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অবশ্য যারা গন্ধ কম পান, করোনায় তাদের তীব্র জটিলতা কম হয়- এটি বিভিন্ন গবেষণাতেও প্রকাশিত হয়েছে। আগে যেমন অনেকেরই গন্ধহীনতার উপসর্গ হতো, এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে কম। বড়দের মতো জ¦র, কাশি, গলাব্যথা তো থাকেই। তবে এবারের করোনায় মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীর ব্যথার কথা বলছে অনেক শিশু। চোখ লাল হওয়া ও শরীরে র্যাশও দেখা যাচ্ছে।
লকডাউনে শুধু জরুরিসেবা দেয়- এমন প্রতিষ্ঠান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান এবং পণ্যবাহী যানবাহন ও শিল্প-কারখানা খোলা থাকবে। সিটি শহরগুলোয় গণপরিবহন চলছে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচলও বন্ধ থাকবে। আর যেসব অফিস চালু রাখার প্রয়োজন রয়েছে, এগুলোকে সীমিত জনবল নিয়ে চালাতে হবে।
সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২২৭টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১২০টি, জিন-এক্সপার্ট ৩৪টি ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭৩টি বরয়েছে। দেশে এখন চলছে করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েব (দ্বিতীয় ঢেউ)। প্রথম দিকের চেয়ে এ সংক্রমণ ইতোমধ্যে রেকর্ড গড়েছে। শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুর দিক থেকেও রেকর্ড। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধ অরোপের পর সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে চরম আতঙ্ক রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন মূল লক্ষ্য।
ইতোমধ্যে প্রথম আঘাত শুরু হয়ে অনেকটা শেষ হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, দেশ এ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। এ ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সবপর্যায়ে যেভাবে নতুন নতুন প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটি একপর্যায়ে থমকে যায়। বর্তমানে সেকেন্ড ওয়েব শুরু হওয়ার পর আবার নতুন করে থমকে যাওয়া ওই প্রয়াসকে এগিয়ে নেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রতিদিন যে হারে এ ভাইরাসে মানুষ সংক্রমতি হচ্ছে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে, সেটি রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রতিনিয়ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশের চিত্র সব মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেজ্ঞরা বলছেন- টিকা নেওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাও এখন জরুরি।
স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ৩০ জেলাকে উচ্চহারে সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামে এ ধরনের সংক্রমণ না ছড়ালেও এখন তা বিপরীত ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আলাদাভাবে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সন্ধ্যা ৬টার পর সব ধরনের দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ করার ঘোষণা কার্যকর করেছে। কিন্তু সংক্রমণের হার ও রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তখন মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে কোভিড রোগীদের জীবন রক্ষার প্রতি। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউসেবাসহ চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগে সরকার সচেষ্ট।
সংক্রমণের আরও বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা, নিয়মত হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা। এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি সবাইকে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যেমন বৃদ্ধি করতে হবে, তেমনি প্রতিটি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা কার্যক্রমকে বেগবান করতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এখন ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক, সাস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে।
যারা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তারা আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন। যুবকদের মধ্যে একটা অবহেলা, উপেক্ষার ভাব রয়েছে। অযথা ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়ার কারণে করোনায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন তারা। ফলে হাসপাতালগুলোয় তাদের সংখ্যা বেশি। স্বাস্থ্যবিধি না মানা, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, আড্ডাবাজিসহ নানা কারণে কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেছেন। এর পাশাপাশি টিকা দেওয়ার পর করোনা জয় করার প্রবণতাও কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তাদের কারণে ঘরের বয়োবৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিষয়টি আতঙ্কের হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এর থেকে পরিত্রাণের মূল উপায় হিসেবে এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট এ দেশটি বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যায় রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সমস্যার কমতি নেই। ইতোমধ্যে বিশ^ব্যাপী কোভিড ১৯-এর হানা এ দেশটিতেও আঘাত হেনেছে। করোনার প্রথম ঢেউ মোটামুটিভাবে সামাল দেওয়া গেছে। সরকারি উদ্যোগে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানের বিষয়টি প্রশংসিত। তা এখনো অব্যাহতভাবে চলছে।
বড়দের মাধ্যমেই শিশুদের করোনা হয়, সেহেতু তাদের করোনা থেকে বাঁচাতে বড়দের দায়িত্বই বেশি। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্যদের অবশ্যই সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র এবং যেখানে ভিড় হয়, সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। কারও সামনে মাস্ক খালা যাবে না। কর্মক্ষেত্র থেকে এসেই শিশুর কাছে যাওয়া যাবে না। আগে কাপড় বদলে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে, গোসল সেরে শিশুর কাছে যতে হবে। শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে শেখাতে হবে। কীভাবে হাঁচি-কাশি দিতে হয়, কীভাবে হাত ধুতে হয়- এসব শেখানো আমাদের দায়িত্ব।
মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা- এই তিন হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল। এই তিন ছাড়া কোনো কিছুতেই উপকার হবে না। বাসার বাইরে বের হলেই এগুলো মানা বাধ্যতামূলক। যারা বাসার বাইরে যাচ্ছেন, তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন- তা হলে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা সংক্রমণের যে প্রচেষ্টা, তা ভেস্তে যাবে। একই সঙ্গে আমাদের জীবনব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ৩০ মিনিট ব্যায়াম এবং তামাক বা ধূমপানজাতীয় মাদকদ্রব্যের নেশা থেকে মুক্ত থাকাই এখন সুস্থ থাকার একমাত্র উপায় ও অবলম্বন।
অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শব্দসৈনিক ও সাম্মানিক উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল