advertisement
advertisement
advertisement.

শওকত আলীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

হাসান-উজ-জামান
২৭ জানুয়ারি ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২২ ১১:০৬ পিএম
advertisement..

শওকত আলী (২৭ জানুয়ারি ১৯৩৭-১৬ নভেম্বর ২০২০) একজন রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা, যিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পেশা শুরু করলেও শওকত আলী ছাত্রজীবনের প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ অর্থাৎ তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সংশ্লিষ্টতার কারণে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থাকাকালীন করাচির মালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিনি ১৯৬৮ সালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হলে শেখ মুজিবসহ অন্যদের সঙ্গে শওকত আলী মুক্তিলাভ করেন। এক বিশাল জনসমুদ্রে ডাকসুর তদানীন্তন ভিপি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। শওকত আলী সাহসিকতার সঙ্গে আগরতলা মামলাকে সত্য মামলা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, তার রচিত ‘সত্য মামলা আগরতলা’ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক গ্রন্থ।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা মামলায় জড়িত থাকার কারণে শওকত আলী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন। দেশ ও জাতির প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতা তথা দেশাত্মবোধের কারণে তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সাবসেক্টর কমান্ডার হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুনরায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। কর্নেল হিসেবে তিনি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

advertisement

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সব সদস্যসহ নির্মমভাবে নিহত হন! বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসেবে কর্নেল (অব.) শওকত আলী স্বাভাবিকভাবেই চাকরিচ্যুত হন এবং তাকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকদের হাতে জাতীয় চার নেতার পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শওকত আলী তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। ১৯৭৫-এর শেষদিকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সাতমসজিদ রোডের বাসভবনে আমার সৌভাগ্য হয় নির্ভীক এই মানুষটির সঙ্গে পরিচয়ের।

শওকত আলী হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একাত্তরের বিজয়গাথা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে অবহিত করে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ ও দেশ গঠনে উজ্জীবিত না করলে মহান মুক্তিযুদ্ধের এবং মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের আত্মার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অসম্পন্ন থেকে যাবে। তাই তিনি ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুসপের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার গঠনতান্ত্রিক বিধান উন্মুক্ত রেখে গেছেন। শওকত আলী মুসপের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে দ্বিধাহীনভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন না করে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন, কারণ মুষ্টিমেয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের রক্তঋণ পরিশোধের স্বার্থে তাদের স্মরণে দেশব্যাপী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ছিল তার স্বপ্ন। সেই লক্ষ্যে তিনি মুসপের মাধ্যমে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

শওকত আলী স্বাধীনতাবিরোধীদের নৃশংসতা উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন বলেই মুসপের মাধ্যমে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল যা বলেছে যা করেছে’ ও ‘একাত্তরের দালালেরা কে কোথায়’ এই পুস্তক দুটি প্রকাশ করায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাতি সোচ্চার হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা বাহুল্য যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দুটি পুস্তকের তথ্য-উপাত্ত আমলে নিয়েছিল, যা শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টিতে সক্ষম হলেও এই আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল শওকত আলীর নেতৃত্বে মুসপের মাধ্যমে।

জাতির পিতার স্বপ্ন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি তথা শোষণহীন সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে শওকত আলী অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন বলেই তার সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের স্লোগান হিসেবে ‘মুক্তিসংগ্রাম চলছে চলবে’কে সন্নিবেশিত করেছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ অন্তরের অন্তস্তলে ধারণ ও লালন করতেন বলেই তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ঘোষণায় প্রথমেই যেহেতু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ উচ্চারণ করেছিলেন অর্থাৎ মুক্তি সংগ্রামকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যেটি অত্যন্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় শওকত আলী হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাঙালি জাতি ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করলেও জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো সাধিত হয়নি, যে লক্ষ্য অর্জনে জাতিকে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে ইস্পাত কঠিন শপথ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করতেন বলেই শওকত আলী তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। গণমানুষের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের অবসান ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণ ছিল তার মৌলিক চিন্তাচেতনা। বর্তমান সময়ে শওকত আলীর মতো উদার, মানবিক গুণের অধিকারী রাজনৈতিক নেতার বড়ই অভাব, যার কাছে অনেক কিছুই শেখার ছিল। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের আগামী দিনের চলার পথের পাথেয়। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন মানুষের মনের গভীরে। মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় বীর শওকত আলীর আজ জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

হাসান-উজ-জামান : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ)