উত্তরের তিন জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, ফসল নষ্টের আশঙ্কা
পাহাড়ি ঢল আর টানা ভারী বৃষ্টিপাতে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে সিলেট অঞ্চলে। প্লাবিত হয়েছে সিলেট জেলার অন্তত ছয়টি উপজেলা। তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল, নদীর ডাইক ভেঙে ডুবেছে ফসলি জমি, আঞ্চলিক সড়ক প্লাবিত হওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কয়েকটি উপজেলার স্বাভাবিক যোগাযোগ। এরই মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। সুরমা নদী উপচে গতকাল সোমবার দুপুর থেকে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে সিলেট নগরেও।
প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল। হঠাৎ করে পানি চলে আসায় সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরসহ ছোট ছোট হাওরের প্রায় ১০০ একর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাদামসহ প্রায় ৫০ একর সবজি ক্ষেতে পানি উঠেছে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার নদ-নদীর পানি বেড়ে
তলিয়ে গেছে বোরো ধান, পেঁয়াজ, ভুট্টা ও শাকসবজির ক্ষেত। এর মধ্যে নিচু এলাকার ক্ষেতের পুরো ফসল নষ্টের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে নতুন করে উজানের ঢল না আসলে এবং বৃষ্টি কমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হতে পারে।
আমাদের ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা আরও জানান-
সিলেট : সোমবার সন্ধ্যায় সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ তিন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদী তীরবর্তী অনেক নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সোমবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১.২৮ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশিদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার এবং কানাইঘাটের লোভা নদীর পানি ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এতে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়কগুলো এখন পানির নিচে। শত শত ফসলি জমি ডুবে আছে। কানাইঘাট পৌর শহরসহ আশপাশের এলাকায় নতুন করে বাসাবাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে ১০৯ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে বন্যাক্রান্তদের জন্য। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে সুরমা নদী উপচে সোমবার দুপুর থেকে সিলেট নগরেও পানি ঢুকতে শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সিলেটে বৃষ্টি কমলেও ঢলের কারণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সোমবার সকাল থেকে সুরমা নদীর তীর উপচে নগরের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে তলিয়ে যায় নগরের উপশহর, সোবহানিঘট, কালিঘাট, ছড়ারপাড়, শেখঘাট, তালতলা, মাছিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। এসব এলাকার বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনায়ও পানি ঢুকে পড়ে।
সুনামগঞ্জ : সোমবার সন্ধ্যায় সুরমা নদীর নবীনগর পয়েন্টে ৭.৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর মাত্র ১০ সেন্টিমিটার পানি বাড়লেই বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে জেলার সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, ঢলের পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
সদর উপজেলার লালপুর গ্রামের বাসিন্দা বিপ্লব মিয়া বলেন, এভাবে হঠাৎ করে পানি চলে আসবে মানুষ কল্পনা করেনি। ঢলের পানিতে অনেক মানুষের পাকা বোরো ধান ও বাদাম পানির নিচে চলে গেছে।
এদিকে টানা বৃষ্টিপাতে রোদের দেখা না পাওয়ায় মাড়াইকৃত ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ভেজা ধান শুকাতে না পারায় ধানে চারা গজানোর কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাজারো কৃষক।
কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রাজারহাট, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী চরগুলোতে বোরো ধান, পেঁয়াজ, ভুট্টা, বাদাম, মরিচ, পটোল, ঝিঙ্গাসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে।
রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তিস্তার চরের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, এনজিও থেকে লোন নিয়ে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছি। কিন্তু জমিতে পানি ঢুকে সব নষ্ট হয়ে গেছে।
চিলমারীর অষ্টমীর চরের কৃষক আইয়ুব আলী জানান, চরের জমিতে মরিচ, পটোল ও ঝিঙ্গা চাষ করেছিলাম। ক্ষেতে আগাম পানি এসে সব তলিয়ে শেষ হয়ে গেছে।
সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের ধরলার পাড়ের কৃষক মতিন জানান, নদীর পাশে প্রায় এক একর জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলাম। সামান্য কিছু কেটে আনতে পেরেছি। বাকি সব পানির নিচে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রশীদ জানান, জেলার নদ-নদী তীরবর্তী এলাকার চরাঞ্চলে প্রায় ৬শ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে পানি ঢুকে পড়েছে। তবে উজানের পানি আসা কমে গেলে এবং অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত কমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হতে পারে।
নীলফামারী : জেলার ডিমলায় নিম্নাঞ্চলের ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে যায়। এ কারণে শ্রমিকেরা পানিতে নেমে ধান কাটতে অনীহা দেখাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের দ্বিগুণ টাকা দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।
সুন্দর খাতা গ্রমের কৃষক বেলাল হোসেন ও মজিবর রহমান জানান, বৃষ্টি হওয়ায় নিচু জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। হেলে পড়া ভেজা ধান কাটতে স্থানীয় শ্রমিকদের মাঝে অনীহা দেখা দিয়েছে। গত বছর বিঘাপ্রতি ধান কাটতে ২-৩ হাজার টাকা খরচ হলেও এ বছর বিঘাপ্রতি ৬-৭ হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, এ অবস্থায় কৃষকদের দ্রুত ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছি। বৃষ্টির কারণে ধান কাটা শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) : সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলের ভুট্টা চাষিরা বিপাকে পড়েছেন।
কাপাসিয়া চরের ভুট্টা চাষি রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি চার বিঘা জমির ভুট্টা ইতোমধ্যে কেটে ঘরে তুলেছেন। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে ভুট্টা শুকাতে পারছেন না।
বেলকা রামডাকুয়া চরের কৃষক মনজু মিয়া জানান, দুই বিঘা জমির ভুট্টা গত এক সপ্তাহ হতে ঘরের মধ্যে জমা রাখা রয়েছে। রোদে শুকাতে না পারায় বিক্রি করতে পারছেন না। সময়মতো ভুট্টা শুকাতে না পারলে তাকে লোকসান গুনতে হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাশিদুল করিব জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলে ভুট্টার ফলন ভালো হয়েছে। বৃষ্টির কারণে ভুট্টা চাষিরা কিছুটা বিপাকে পড়েছেন।