পদ্মা সেতু নিয়ে আজকের এ জয়জয়কার-উল্লাসের পেছনটা যে কত ষড়যন্ত্রে ঠাসা, তা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে না তো? দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে স্বপ্নের সেতুটির পূর্ণতা এক মহাকাব্যের মতো। অস্তিত্বহীন জনৈক হেলালের ভুয়া চিঠিও কত সর্বনাশ করে দিতে পারে, তা স্মরণে রাখলে এটি সামনে এগোনোর পাঠ্য হতে পারে বিশ্বের যে কোনো জাতির জন্য।
ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসনসহ পদ্মা সেতুর যাবতীয় কাজ চলেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। গতি থমকে গেছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। পদ্মা সেতুর ডিজাইন কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কিছুদিন পরই। প্রাথমিক ডিজাইন হয় পরের বছরের সেপ্টেম্বরে। প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বানের পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয় ২০১১ সালে। পরের বছরই দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও ঋণচুক্তি বাতিল। ষড়যন্ত্রের মেগাসিরিয়াল শুরু। অত্যন্ত ঠা-া মাথায় সাজানো হয় এসএনসি লাভালিন কর্মকর্তা রমেশ সাহার কথিত ডায়েরির ঘুষ ষড়যন্ত্রের তথ্য পাওয়ার গল্প।
একদিকে অভিযোগের জবাব, আরেকদিকে চলেছে পদ্মা সেতু তৈরির অবিরাম মহাযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী সেতুটির মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। ওই সময়টায় আত্মোপলব্ধিতে আসে বিশ্বব্যাংক। এত বড় প্রকল্প থেকে সরে যাওয়া ঠিক হয়নি বুঝতে পেরে বলেছে, সেতুটি হচ্ছে বাংলাদেশের স্টিল লাইফলাইন। বিশ্বব্যাংকের এমন বুঝ বা বিলম্বিত উপলব্ধিতে তখন আর কিছু যায় আসেনি। ততদিনে সত্য উন্মোচন হলেও, অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হলেও সমালোচনার তীর সইতে হয়েছে সরকারকে। আবার পদ্মা সেতুর কাজও এগিয়ে নিতে হয়েছে। না হলে আরও ৯ বছর আগে ২০১৩-১৪ সাল নাগাদই দৃশ্যমান হতো সেতুটি। এসবের আলোকে পদ্মা সেতু কেবল সরকারকে নয়, বাংলাদেশকেও আরেকটি গর্ব-অহঙ্কার-গৌরবের প্রতীক করেছে। বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে বাংলাদেশের প্রকৌশলী, কর্মীদের সক্ষমতা ও দক্ষতা। একই সঙ্গে এমন স্থাপনা তৈরিতে বাংলাদেশি রড-সিমেন্টসহ নির্মাণ পণ্যের গুণগত মানের স্বীকৃতি। আরেক বিবেচনায় পদ্মা সেতুকে অপমানের প্রতিশোধ ও ষড়যন্ত্রের জবাবও বলা যায়। গালগল্প আর গুজব যে এক সময় বুমেরাং হয়, ওই সত্যতাও প্রমাণ হয়েছে। যখন পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো ঠিকাদারই নিয়োগ হয়নি, কোনো অর্থও ছাড় হয়নি- ওই পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের আনা দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশকে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছে। আর পদ্মা সেতু অর্থায়ন না করার দায় বিশ্বব্যাংককে নিতে হয়েছে। আরও ১০০ বছরেও পদ্মা সেতুর মতো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ বিশ্বব্যাংক পাবে কিনা, কে জানে!
এই পদ্মা সেতুর সুবাদে পাল্টে যাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের চেহারা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুলবে নতুন দুয়ার। প্রবৃদ্ধির চাকায় যোগ হবে বড় প্রণোদনা। পদ্মা সেতুর হিসাবটি শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা নয়, ঢাকার সঙ্গে দূরুত্ব কমে যাওয়ার নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা জিডিপির প্রবৃদ্ধিরও নয়- পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সম্মানের প্রশ্ন। সরকারের জন্য অবশ্যই এটি একটি বড় রাজনৈতিক উপাদান। আবেগের বিষয়ও।
অর্থনীতি সম্পর্কে সাধারণ বুঝজ্ঞানের সব মানুষও বুঝতে পারছে, মেগাপ্রজেক্ট বা বিদেশি ঋণ নয়- সমস্যা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্জন খুব বেশি না হলেও কম নয়। এক দশকেরও বেশি ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে ৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ৩ বছর ৭ এবং একবার ৮ শতাংশের ওপরেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। করোনার ধকলে এতে ছেদ পড়েছে। চলতি অর্থবছরে আবার একটু গাঝাড়া পড়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে সরকারের দেওয়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন রকমের প্রণোদনা ও ক্রমবর্ধমান অবকাঠামো। দুর্নীতি, অনিয়ম, কারচুপি ও সময়ক্ষেপণ না থাকলে অগ্রগতির গতি আরও বেগবান থাকত। এদিকটায় গুরুত্ব না দিয়ে একেবারে যত দোষ নন্দঘোষের মতো প্রকল্পক ও বিদেশি ঋণই দোষী করার প্রবণতা সুস্থতা নয়।
বাংলাদেশের অর্জনের পেছনে বিদেশি ঋণের সংযুক্তি কম নয়। প্রতিবছর বাজেটের সাইজ বাড়ছে। আয়ের আগে ব্যয় ঠিক করে ফেলছে সরকার। এর পরিণামে প্রতিবছরই সরকার ঘাটতি বাজেট করেছে। ঘাটতির এক অংশ জোগান হচ্ছে স্থায়ীয় মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে, আরেক অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় গ্রহণ করা ঋণ ও অনুদান থেকে। বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত জোগানের ফলেই দেশের এ অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার জোগানের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক ঋণ। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ না নিলে সম্ভব হতো না এত ব্যাপক পরিমাণের অবকাঠামো নির্মাণ।
সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা থাকলেই কারও মূলধন ছাড়াও ঋণ নেওয়ার সাহস জন্মায়। বাংলাদেশের তা আছে। করোনাকালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হলেও থমকে যায়নি। কৃষি উৎপাদন, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক রপ্তানির গতি আগের চেয়ে বরং বেড়েছে। এ কয়েকটি খাতে বাংলাদেশ হিসাবে বড় পাকা।
গবেষণা দরকার এত দুর্নীতি ও লুটপাটের মধ্যেও কীভাবে সম্ভব হলো পদ্মা সেতুর মতো স্বপ্ন বাস্তবায়ন? আগামী ডিসেম্বরে উন্মুক্ত হবে মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ। অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতিও মন্দ নয়। বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণকাজের সর্বশেষ অগ্রগতি ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণকাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। আগামী অক্টোবরে চলাচলের জন্য এই টানেল খুলে দিতে চায় সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনার পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, দোহাজারী-ঘুনধুম ডুয়েলগেজ ট্র্যাক প্রকল্পের কাজে নাড়া পড়েছে।
২০২৫ সাল নাগাদ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা রেল লিংক ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অনেক মেগাপ্রকল্পের মেয়াদকাল শেষ হয়ে ঋণ পরিশোধকাল শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তখন বড় ধরনের ঋণ পরিশোধের বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশের। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময় ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের চাপ সামলাতে কর আহরণ বৃদ্ধি করা, বহির্খাতের বর্তমান চাপ মোকাবিলায় সুরক্ষা দেওয়া এবং এ ধরনের উন্নয়নকাজকে মওকা হিসেবে নিয়ে লুটপাট ও দুর্নীতিতে লিপ্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়- এ বিষয়ক পরামর্শ জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন