উদ্বেগ জানিয়ে ১৭ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি
নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসকে হেনস্তা এবং সাভারের আশুলিয়ায় বখাটে শিক্ষার্থীর হামলায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক।
নড়াইল প্রতিনিধি জানান, অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে হেনস্তা, শিক্ষকদের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় সদর থানায় গত সোমবার রাতে ২০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিনই রাতেই ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো- সদরের মির্জাপুর বাজারের মোবাইল ম্যাকানিক শাওন খান, স্থানীয় নুরানি মাদ্রাসার
শিক্ষক মনিরুল ইসলাম এবং অটোচালক রিমন আলী।
মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে মহানবী (স)কে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ায় গত ১৮ জুন উত্তেজনা দেখা দেয়। ওইদিন বিক্ষুব্ধ লোকজন কলেজশিক্ষকদের ৩টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় এবং অভিযুক্ত ছাত্র ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। পরে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এদিকে ঘটনার সময় অভিযুক্ত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সোমবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা হয়। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদর থানার ওসি শওকত কবির ৩ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা কেউ পার পাবে না বলে মন্তব্য করেন। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাভারে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার নিহতের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। ঘাতক শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণ। জিতুকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেন হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশ নেন সর্বস্তরের জনগণ। পরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। অন্যদিকে সাভার ও আশুলিয়া স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে অধর চন্দ্র স্কুল মাঠে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেন। সমাবেশ থেকে অবিলম্বে শিক্ষক হত্যাকারী ওই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের হুশিয়ারি দেন শিক্ষকরা।
এদিকে নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও সাভারে শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়েছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ সমাবেশ হয়। সেখানে অংশ নিয়ে ঢাবির জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের পরিবারের ইতিহাস দেখতে হবে। পরিবার তাদের শিক্ষাদানে ব্যর্থ। তাই ঘটনার দায়ভার পরিবারকেও নিতে হবে।
শিক্ষক সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিহির লাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি যেখানে সবসময় দেশের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেখানে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। সব শিক্ষক সমিতির উচিত শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করা। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, শিক্ষক লাঞ্ছনার দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন।’
১৭ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি
আশুলিয়ায় শিক্ষক হত্যা ও নড়াইলে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তারা বলেন, বাংলাদেশের সমাজ ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পথ হারানোর আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
বিবৃতিতে বলা হয়, চলমান ঘটনায় প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত। দেশে মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদা অদৃশ্য। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাম্প্রদায়িকসহ সব অপশক্তিকে কঠোর হস্তে দমন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। বিবৃতিদাতারা হলেন- হাসান ইমাম, অনুপম সেন, সেলিনা হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, সারোওয়ার আলী, ফেরদৌসী মজুমদার, আবেদ খান, আবদুস সেলিম, লায়লা হাসান, মফিদুল হক, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, হারুণ হাবীব, শফি আহমেদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শিমূল ইউসুফ ও সারা যাকের।