‘কাগজ, কালি, মন লিখে তিনজন’- এই প্রবাদের প্রাসঙ্গিকতা এখনো বিরাজমান। মনের ভাবের বহির্প্রকাশে গুহাচিত্র, মাটির চাত্কি, ভেলাম, পাচ্মেন্ট, প্যাপিরাস অতঃপর লিখন মাধ্যম হিসেবে স্বত্বসিদ্ধ হয় কাগজ। পূর্ববঙ্গে পাট হতে কাগজের সনাতনী রূপের আফসানি ও তুলোট কাগজের হাত ধরেই আসে বিলেতি মসৃণ কাগজ। কাগজ ও শিক্ষা উপকরণের দরবৃদ্ধিতে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা সব সময় তাতিয়ে থাকত। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বরাজ, পাকিস্তান পর্বে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল কাগজসহ শিক্ষা উপকরণের সুলভ মূল্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই সুযোগে মতলববাজ কিছু মানুষ ব্যবসার সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশুখাদ্য থেকে শিক্ষা উপকরণ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সভায় সভাপতি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন কাগজের দর মুদ্রণ উপকরণ নিয়ে তৎসময়ে বলেছিলেন- কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে আকর্ষণীয় কাগজ তৈরি ও তার সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং তার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার, সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশকদের কর রেয়াত, বইয়ের ডাক মাসুল হ্রাস ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংগঠনগুলো কাগজসহ শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে সোচ্চার থাকত সব সময়। এমনকি সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোও শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করেনি।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক হতে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। ছাত্র-সংগঠনগুলো অতিমাত্রায় মাদার সংগঠনের অনুগামী ও ছাত্র রাজনীতিতে ব্যবসার সংযোগ ঘটলে ছাত্ররা নিজেদের অধিকার সচেতনার আন্দোলন থেকে নিজেদের অনেকাংশে বিযুক্ত করে। পাহারাদারের অভাবে অরক্ষিত হয় কাগজসহ শিক্ষা উপকরণের দর। জেঁকে বসতে থাকে সিন্ডিকেট। বিশেষজ্ঞদের অভিমত আমাদের গৌরবের কর্ণফুলী পেপার মিল, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল, পাকশী পেপার মিলের বর্তমান করুণ দশায় সিন্ডিকেট প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সরকারি ব্যবস্থাপনার এসব মিলের সাথে গত দিন দশকে ছোট-বড় মিলিয়ে ষাটের অধিক কাগজের কল আছে বাংলাদেশে। খুশির বিষয় এসব মিলের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১০ লাখ টন- যা দেশের মোট চাহিদার চেয়ে বেশি। অথচ কাগজের বাজার উৎপাদক মিল মালিকদের ভোজবাজিতে অস্থিতিশীল থাকে।
কাগজের মূল উপাদান উদ্ভিজ্জ এবং তন্তুযুক্ত হলেও বাংলাদেশে পুরনো কাগজ ও বর্জ্য কাগজকে পাল্পর সঙ্গে মিশিয়ে রিসাইক্লিং করে কাগজ তৈরি হয়। ফলে প্রধান উপকরণ আমদানিনির্ভর পলিপের ওপর চাপ কম। কিন্তু বিভিন্ন সিন্ডিকেটের সব কাগজের মিল মালিক, এজেন্সি ও পাইকারি বিক্রেতারা সিন্ডিকেট করে অযাচিত মূল্যবৃদ্ধি করে নানা সময়। কাগজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এমনকি ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো তাড়না লক্ষণীয় নয়। কেউ যেন দেখার নেই। আমরা ক্রমেই সব মেনে নেওয়ার জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের সহনমাত্রা পর্বতসম।
গত তিন-চার মাসে কাগজের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রকাশনা ও মুদ্রণকাজে ব্যবহৃত কাগজের দাম ৭০-৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কোনো বিবেচনায়ই এটা যৌক্তিক নয়। মিল মালিকরা এই সময়ের সর্বপ্রচলিত দোহাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলছে। এ কথা মানছি কাগজ তৈরির কাঁচামাল ও কাগজ শুকানোর জন্য যে বাল্ব ব্যবহার হয় তার মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু কোনো বিবেচনায় রিমপ্রতি কাগজের দর ৭০-৮০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণ নেই।
রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেন থেকে কিছু কাগজ আমদানি হলেও তা প্রধানত মুদ্রণ ও প্রকাশনা খাতে ব্যবহান হয় না। মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ব্যবহৃত কাগজের অধিকাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। এই সেক্টরে আমদানিনির্ভরতার অংশী দেশের প্রধান প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়া। তা হলে বাজারে এত দরবৃদ্ধির কারণ কী? বাজারে কাগজের স্বল্পতা খুব একটা নেই কিন্তু এত উচ্চমূল্য দিয়ে প্রকাশক ও মুদ্রকরা বই মুদ্রণে অনীহার মাঝে আছে। প্রকাশনা সেক্টর এখন স্থবির।
বিগত ৪০ বছরে বিশ্বে কাগজের ব্যবহার ৪০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশও এই ধারায় যুক্ত। অথচ মেধা-মনন ও সৃজনকর্মের বিকাশের প্রত্যক্ষ উপাদান কাগজের প্রতি সরকারি রেগুলেটরি এজেন্সিগুলোর তদারকির অভাব দৃশ্যমান।
করোনার কারণে কেবল সৃজনশীল প্রকাশনা খাতেই ক্ষতি হয়েছে কমবেশি ৪০০ কোটি টাকা। এই খাত এমনিতেই প্রণোদনার অভাবে পূর্ব থেকে দুর্বল। সম্প্রতি কাগজের বাজারের তথৈবছ অবস্থা এই খাতকে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সুকুমার মাধ্যম সৃজনশীল প্রকাশনার প্রতি সরকারের ভাষণ-বিবৃতি আন্তরিক হলেও এ খাতের উন্নয়নে প্রণিধানযোগ্য প্রণোদনা একেবারেই স্বল্প।
বর্তমানে বাংলাদেশে কাগজের আমদানিকৃত ম-, বর্জ্য কাগজ, লেখার কাগজ, কাগজের বোর্ড ইত্যাদির ব্যয় বার্ষিক প্রায় ৪ বিলিয়ন টাকা। এই ব্যয়ের বড় অংশীজন প্রকাশনা খাত। অথচ কাগজনির্ভর অন্য শিল্পগুলো কিছু সুবিধা পেলেও প্রকাশনা খাত পায় না। কাগজ আমদানির ক্ষেত্রেও প্রকাশনা সেক্টরের কাগজের জন্য বর্তমানে সব মিলিয়ে আমদানি শুল্ক ৪৭%। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এর হার ১৮%, ইন্দোনেশিয়ায় ১৯%, চীনে ১৭%। সরকার অস্থির কাগজের বাজার স্থির করতে উদ্যোগ না নিলেও আমদানি শুল্কবৃদ্ধিতে প্রতিবছরই তৎপর হয়।
বিশ্বে প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং পণ্যের আউটসোর্সিং বাজারের আকার ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের জন্যও কাগজের বাজারে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। দেশে ১১ ধরনের কাগজ উৎপাদন হয় বাকিটা আমদানিনির্ভর। এক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য ও বহুমুখিকরণও প্রয়োজন।
সর্বাগ্রে প্রয়োজন কাগজের মতো শৈল্পিক পণ্যের জন্য একটি সুষম ব্যবস্থা। কাগজের উৎপাদক ও কারবারিরা যেন সিন্ডিকেটের উপনিবেশ না বানায় সেদিকে কঠোর নিবারণমূলক ব্যবস্থা জরুরি। যদি এক্ষুনি সরকার কাগজের বাজার নিয়ন্ত্রণে যথার্থ ব্যবস্থা না নেয় তা হলে দেশের শিল্প, সাহিত্য, প্রকাশনা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে এসডিজির লক্ষ্যপূরণে ২০৪১ সালের মধ্যে আর্থিক ও মানসিক সূচকের যুৎপদ উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে ব্রতে সরকার নিয়োজিত সে যাত্রায় সৃজনশীল সুকুমার মাধ্যমগুলোর উন্নয়ন অত্যাবশ্যক।
প্রতিবেশী দেশে ইতোমধ্যে কাগজের দর সামান্য বৃদ্ধিতে কয়েকটি সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে- এসব অশনি সংকেত।
সব সম্ভবের দেশ আমার প্রিয় বাংলাদেশ। সোয়াবিন তেল নিয়ে সিন্ডিকেট ২/৩ দিনের মধ্যে ইতোপূর্বে বাজার থেকে উধাও করে দিয়েছিল সব তেল। পরে সরকার দরবৃদ্ধির ঘোষণার পর বাজারে ৩/৪ দিনের মধ্যে তেল চলে এলো। শুধু এতেই শেষ নয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দেশে মিলল অসংখ্য সোয়াবিনের খনি। কাগজের ক্ষেত্রেও মনে হচ্ছে যাত্রা সে পথেই। কিন্তু রাস টানা প্রয়োজন না হলে সমূহ বিপদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ বর্তমান সরকার সেদিকে শীঘ্রই নজর দেবে বলে আমাদের বিশ^াস।
বৈশি^ক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন একটা বাস্তবতা। কিন্তু সেই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে যারা সিন্ডিকেট করে দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে সরকারের যে কোনো মূল্য তার নিবারণ প্রয়োজন।
কাগজের বাজারের লাগাম টানতে মিল মালিকদের সহায়তার আশা করা বোকামি মাত্র। এ জন্য দুর্বার সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশের সরকার ব্যবস্থার একটা চিরচেনা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আন্দোলন- যা টনিকের মতো কাজ করে। মানুষের সৃজন ও প্রকাশের পথে যারা অন্তরায় তাদের আর ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। মিল মালিক ও কাগজের কারবারিদের বিরুদ্ধে কুলুপ এঁটে বসে না থেকে যে যার অবস্থান থেকে কর্মযোগ প্রয়োজন। সামাজিক দুরাচার মেরামতের কাজটায় সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে- বিবেকের তাড়না থেকেই। না হলে একদিন নিজেকেও ক্ষমা করা যাবে না।
খান মাহবুব : গবেষক ও প্রাবন্ধিক