একজন মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাই হচ্ছে স্বাস্থ্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্র বড়ই করুণ। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতনতা আমাদের জাতিগত বিচারে নিতান্তই কম। অথচ আমাদের শতকরা ৮০ ভাগ রোগই প্রতিরোধযোগ্য। সাধারণ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যবিধিগুলো সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকার কারণে সহজ প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলোতে ভুগে অহেতুক স্বাস্থ্যহানি করছে। সুস্থতার জন্য আমাদের সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ এ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। কারণ এখানে স্বাস্থ্যসমস্যা প্রকট। যদিও পাঁচ দশকে গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। যেমন বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ৩ হাজার ৯০০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ১ হাজার ৩১২টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। রয়েছে স্যাটেলাইট ক্লিনিক ও ইপিআই সেন্টার। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ সেবা। রয়েছে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু তার পরও গ্রামীণ মানুষ কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। কারণ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রয়েছে চিকিৎসা প্রদানে অবহেলা, উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে ব্যয় বৃদ্ধিসহ মান নিয়ে নানা প্রশ্ন।
আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত এবং অসচেতন। দরিদ্রতার সঙ্গে অশিক্ষা, অজ্ঞতা এবং অস্বাস্থ্য তাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান বা সতর্কতা নেই বললেই চলে। শিশু, পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ সবাই অবহেলার শিকার। চিকিৎসার অভাবে কিংবা অজ্ঞতার কারণে গ্রামীণ সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অন্যদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অবহেলিত এ গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে আছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং কুসংস্কারের জোরালো প্রভাব, যা স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করতে তাদের ভীষণভাবে অনুৎসাহিত করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ আজও অনেকে আদিম বিশ্বাসকে আঁকড়িয়ে আছে।
আমরা যদি দেশের বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, দেখা যাবে তাদের প্রত্যেকটিতে রয়েছে শুধু অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা এবং চিকিৎসায় অবহেলা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা পয়সায় একটু চিকিৎসার প্রত্যাশায় গরিব ও অসহায় জনগণ প্রায় প্রতিদিনই ছোটে দূর-দূরান্ত থেকে। কিন্তু ‘প্রেসক্রিপশন’ অনুযায়ী প্রায় সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনে নিতে হয় তাদের। অর্থের অভাবে অনেকের পক্ষে ওষুধ কেনাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ওষুধের অভাবে মরতে হয় অকালে। প্রাইভেট ক্লিনিকে প্রচুর সময় ব্যয় করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি রোগীকে এভাবে অবহেলা করা হয়, তা হলে তো কথাই নেই!
বর্তমানে দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য অব্যাহত চলছে এবং আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের বদৌলতে দেশে অনেক চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার আড়ম্বর দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিজ্ঞাপনে গ্যারান্টি দিয়ে অসুখ সারানোার কথাও বলা হচ্ছে। স্বপ্নে প্রাপ্ত বিভিন্ন ওষুধের ওপর অসহায় ও সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করার দুর্বার প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। বিভিন্ন পত্রিকায় বিরাট পাতাজুড়ে থাকে এসব বিজ্ঞাপন। রাজপথে, ফুটপাতে এ ধরনের সর্বরোগহারী ওষুধ বিক্রেতাদের অভাব নেই। সহজ ও সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড বিশ্বাসে এসব ওষুধের ওপর ঝুঁকে পড়ে সঙ্গত কারণেই। অথচ বাস্তবে এসব ওষুধের বিজ্ঞানসম্মত কোনো গ্যারান্টি নেই এবং রোগ ভালো হওয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন ওষুধের বিষক্রিয়া ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভোগে অসহায় ও সাধারণ জনগণ।
স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা সবদিক থেকেই আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের অজ্ঞতা এবং চিকিৎসকদের অবহেলা ও অর্থনৈতিক প্রলোভনে স্বাস্থ্যরক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। উচ্চবিত্তসম্পন্নরা ভালো চিকিৎসার জন্য অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমালেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে তাদের রোগব্যাধি ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় দৈনন্দিন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাসহ প্রতিটি সচেতন নাগরিককে তাই সমাজের অসহায়-অবহেলিত মানুষদের রোগ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে এবং পাশাপাশি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে পর্যাপ্ত ওষুধ ও সুচিকিৎসা লাভ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করাটা সবচেয়ে জরুরি। এ সমন্বয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ অঞ্চলের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মচারীদের আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। এক সময় ঢাকাকে তিলোত্তমা নগর হিসেবে গড়ে তোলার ঝোঁক ছিল। এখন গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়নের প্রতি আমাদের অগ্রাধিকার প্রদানের কোনো বিকল্প নেই।
প্রদীপ সাহা : কলাম লেখক