গাজীপুরে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ক্লিনিকের ছড়াছড়ি
রাজধানী লাগোয়া শিল্পনগরী গাজীপুর। অর্ধকোটি মানুষের বসবাস এ জেলায়। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার সুযোগে জেলার প্রতিটি উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এগুলোর বেশিরভাগেরই নিবন্ধন নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে মানহীন পরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্ট-নার্সের অভাব, ভুল চিকিৎসার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। এসব কারণে কখনো কখোনো রোগ নিরাময়ের জন্য এসে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
জানা যায়, অবৈধ এসব চিকিৎসালয় বন্ধে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, বন্ধ ঘোষণার পরও অবৈধ সুবিধা নিয়ে আবার তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। এমনও হয়েছে সকালে ‘বন্ধ’ ঘোষণার পর বিকালই আবার চালু হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, নজরদারির নামে বেসরকারি এসব হাসপাতালে নিয়মিত অর্থ বাণিজ্য করে জেলা ও উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগ।
শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় গত ২৭ মে পপুলার মেডিক্যাল সেন্টার ও আনোয়ারা ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। নিবন্ধন সনদ না থাকায় দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। কিন্তু বাস্তবে সে নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। অভিযানের দিন বিকাল থেকেই কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠান দুটি। কাগজপত্রে বন্ধ হলেও এভাবে শুধু শ্রীপুরেই চলছে নিবন্ধনবিহীন ২৭টি প্রতিষ্ঠান। এমন চিত্র জেলার সর্বত্রই।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় মোট চারশ বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদের মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১১৪টি, ক্লিনিক ১৯টি, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক উভয় সংযুক্ত ২৬৪টি, ব্লাড ব্যাংক ৩টি। এ ছাড়া অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে ১৩৯টি প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি তারা অবৈধভাবে পরিচালিত ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। সিভিল সার্জনের তালিকায় ‘বন্ধ’ থাকলেও বাস্তবে এগুলোর কার্যক্রম চলছে।
একাধিক ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেতে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজনের পেছনেও মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। পরিদর্শনের নামেও বিশেষ একটি ফি নেন স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন। এ ছাড়া নিবন্ধনের যেসব যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন বেশিরভাগেরই তা নেই। এসব কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিতে পারে না। কিন্তু নজরদারির অভাবে ইচ্ছা মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বেসরকারি এসব হাসপাতালে চলতি বছরেই ভুল চিকিৎসা নয়জন রোগী মারা গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৫ মার্চ শ্রীপুরের নিউ এশিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভুল গ্রুপের রক্ত সঞ্চালন করায় রুনা আক্তার নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। এর পর ২৩ আগস্ট কালিগঞ্জের জনসেবা জেনারেল হাসপাতালে ভুল গ্রুপের রক্ত শরীরে সঞ্চালন করায় শিরিনা আক্তার নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। গত ১৫ অক্টোবর কাপাসিয়ার আমরাইদ পপুলার হাসপাতালে টনসিলের অপারেশন করাতে গেলে শ্বাসনালি কেটে ফেলায় আলমগীর হোসেন নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ঢাকা ইম্পেরিয়াল হাসাপাতালে চিকিৎসকদের ভুলে লাভলী আক্তার নামে কলেজ শিক্ষার্থী মারা যায়। ৫ সেপ্টেম্বর কালিয়াকৈরের তানহা হেলথ কেয়ারে চিকিৎসকদের ভুলে আরিফা আক্তার নামের এক শিক্ষার্থী মৃত্যু হয়। ১৪ অক্টোবর শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার নিউ পদ্মা হাসপাতালে কল্পনা আক্তার নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। ১২ সেপ্টেম্বর শ্রীপুরের জায়েদা মাল্টিকেয়ার নামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এক রোগীর গর্ভের সন্তান হত্যার অভিযোগে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন এক ব্যক্তি।
এভাবে চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আপস মীমাংসা করে ফেলায় তা আর বিচারের মুখ দেখে না। আর সিভিল সার্জন শুধু তদন্তের কথা বলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের দায় এড়িয়ে যান।
এদিকে জেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধনকৃত ৪ প্রতিষ্ঠান থাকলেও পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ২০টির। জেলায় এখনো মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এ কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব হাসপাতালের বর্র্জ্য বেশিরভাগই নিজস্বভাবে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় খাল, বিল, নদী কিংবা সড়কের পাশে ফেলে আসা হয়। পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলা এসব মেডিক্যাল বর্জ্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এ কারণে ২০২১ সালে গাজীপুরে পরিবেশের ছাড়পত্রবিহীন ক্লিনিক হাসপাতাল বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। সে বছরের ৭ সেপ্টেম্বর রিটটি দাখিল করেছিলেন মেহেদী হাসান নামে মহানগরের এক বাসিন্দা। এর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
এ বিষয়ে গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান বলেন, আমরা অভিযানে জেলার অনুমোদনহীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন শুনছি সেগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে। আসলে আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে এগুলো নজরদারির নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো বন্ধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এগুলো বন্ধ করার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকেও বলা হয়েছে।’ তবে বেসরকারি হাসপাতালে নজরদারির নামে জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্রবিহীন প্রতিষ্ঠানে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে তাদের সতর্ক করছি। পাশাপাশি প্রিজন বাংলাদেশ নামের একটি এনজিও নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে মেডিক্যাল বর্র্জ্য সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে যায়। তাদের গাজীপুরে একটি প্রকল্প করার কথা রয়েছে।