দেশ : স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা
কী ভাবছেন, প্রিয় পাঠক/পাঠিকা?
ঘুম থেকে উঠেছেন সকালে। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে হয়তো বসেছেন, পাশে চায়ের কাপ থেকে ভাপ উঠছে। সকালের কচি সোনারোদ এসে পড়েছে খোলা জানালা দিয়ে। একটু শীত-শীত ভাব। উত্তরাঞ্চলে হয়তো শীত এসেও গেছে চাদরমুড়ি দিয়ে! তবে ক্যালেন্ডারে শীতঋতু আসতে কিছুটা বাকি। এখনও হেমন্ত চলছে। তাই আপনার মনে পড়তে পারে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন, ‘হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে, দুইপা ছড়ায়ে ব’স এইখানে পৃথিবীর কোলে...।’
এই সময়টাতে মন হালকা থাকার কথা। হালকা মনেই খবরের কাগজে চোখ রেখেছেন। শিরোনামগুলো দেখে নিচ্ছেন। অনেক খবর। পুরনো একটা গানের কথাও মাথায় গুনগুনিয়ে উঠেছে, ‘...প্রতিদিন কত খবর আসে যে খবরের পাতা ভরে।’ কিছুটা সময় গড়িয়েছে, এরই মধ্যে পাতাভরা খবরের শিরোনাম পড়তে পড়তে আপনার ভুরু কুঁচকে গেছে, টের পাচ্ছেন হালকা মন ভারী হতে শুরু করেছে, কবিতা আর গানের লাইন কখন যেন উধাও হয়ে গেছে মাথা থেকে।
‘১০ ডিসেম্বর ঘিরে শঙ্কার মেঘ: দুদিন আগেই রাজধানী দখলে নেবে আ.লীগ/আগেই নেতাকর্মী ঢাকায় আসার প্রস্তুতি বিএনপির,’ ‘আঙুলে অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু,’ ‘বেতন বকেয়া: পরীক্ষার্থীদের বের করে দিলেন প্রধান শিক্ষক,’ ‘রুবিনাকে এক কিমি ছেঁচড়ে নিল প্রাইভেটকার, মৃত্যু,’ ‘নরসিংদীতে আবারও মাদ্রাসার শৌচাগারে মিলল ছাত্রীর লাশ,’ ‘চট্টগ্রামে রেকর্ডসংখ্যক জিপিএ-৫: ভর্তির সুযোগ নেই বিজ্ঞানের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর,’ ‘কিশোর গ্যাংয়ের হামলা: কাপাসিয়ায় বৃদ্ধের মৃত্যু, চৌদ্দগ্রামে তরুণ খুন,’ ‘যশোরে কাভার্ডভ্যান হোটেলে/বাবা-ছেলেসহ নিহত ৫ জন,’ ‘বিয়েবাড়িতে সংঘর্ষে কনের দাদি নিহত: বরসহ গ্রেপ্তার ১২,’ ‘খাগড়াছড়ির সড়কে যুবকের গলা কাটা লাশ,’ ‘কেশবপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যার হুমকি,’ ‘মতিঝিলে ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত,’ ‘থমকে আছে রানওয়ে সম্প্রসারণ,’ ‘নিমসারে অধিগ্রহণ করা জমিতে অবৈধ আড়ত,’ ‘নামেই ৫০ শয্যার হাসপাতাল,’ ‘প্রভাবশালীদের কব্জায় রাঙ্গাবালীর খালনালা,’ ‘মাছের পেটে বিষ দিয়ে অবাধে পাখি শিকার,’ এইসব পড়ার পর মেজাজ কেন বিগড়ে যাচ্ছে তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন থাকে না। সুন্দর সকালটা মাটি হয়ে গেল, ‘ধুত্তোর’ বলে খবরের কাগজটা ফেলে দিলেনÑ আপনাকে নিশ্চয় দোষ দেয়া যাবে না।
এগুলো একদিনের খবর। এইসব খবরই আমরা প্রতিদিন পড়ি খবরের কাগজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘হিং টিং ছট’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার।’ বহু পুরাতন ঘটনাই ঘটে চলেছে বারবার, সংবাদকর্মীরা প্রতিদিন তা নতুন করে আবিষ্কার করেন, পত্রিকায় ছেপে পরিবেশন করা হয় পাঠকমহলে। ভাল খবর কি থাকে না? থাকে। খারাপের ভিড়ে হারিয়ে যায়।
পাঠকমহল নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, ১০ ডিসেম্বর নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানারকম প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে। ওইদিন রাজধানীতে গণসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে বেশ চাপান-উতোর চলছে। সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ২৮ নভেম্বর সোমবার বিকেলে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বলেছেন, ‘১০ ডিসেম্বর আমরাও প্রস্তুত আছি। খেলা হবে।’
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আপনারা প্রশ্ন করবেন নাÑ‘কিসের খেলা?’ মন্ত্রী মহোদয় ভুল কিছু বলেননি। রাজনীতি এ দেশে খেলাই। বেশ বড় মাপের খেলা। আমরা, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা এ দেশের সাধারণ নাগরিকরা, এই খেলাটা সম্পর্কে জানি না। না-জানার সমস্যা আমাদেরই, অন্য কারও নয়।
বিদেশ : হায় রবীন্দ্রনাথ! হায় জীবনানন্দ!
প্রিয় পাঠক/পাঠিকারা হয়তো অনেকেই চলচ্চিত্র দেখে থাকেন। ভারতীয় তথা হিন্দি চলচ্চিত্র যারা দেখেন, কিংবা খোঁজখবর রাখেন, তারা হয়তো পরেশ রাওয়ালকে চিনতে পারবেন। পরেশ রাওয়াল ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ৩০ মে। হোলি, নাম, কব্জা, দৌড়, কিং আঙ্কল, বাজি, রাম লখন, আন্দাজ আপনা আপনা, ক্রান্তিবীর, হেরা ফেরি, ফির হেরা ফেরি, গরম মাসালা, ভাগম ভাগ, হাঙ্গামা ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ভারতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন রাওয়াল। এছাড়া শতাধিক চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ‘সরদার’ নামক চলচ্চিত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বল্লভভাই প্যাটেল চরিত্রে তার অভিনয়। ২০১৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী সম্মাননা, ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ৭২ বছর বয়সী এই অভিনেতা গুজরাটের আহমেদাবাদ পূর্ব থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংসদ সদস্য ছিলেন। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির রাজনীতিতেই যুক্ত আছেন এখনও।
বুঝতেই পারছেন, পরেশ রাওয়াল গুণী অভিনেতা। সম্প্রতি গুজরাটের ভালসাদ জেলায় বিজেপির হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। সেখানে অনেক কথা বলেছেন। রান্নার গ্যাস, চাকরি-বাকরি। এসব প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে। কিন্তু কমেও যাবে; লোকজন চাকরিও পাবে। কিন্তু কেমন লাগবে, যদি দেখেন দিল্লির মতো আপনার ঘরের পাশে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা বসবাস করছে? তখন রান্নার গ্যাস দিয়ে করবেনটা কী? বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করবেন?’
মাছে-ভাতে বাঙালি। ঠিক আছে, রাওয়াল সাহেব খুব খারাপ বলেননি। বাঙালিরা বিড়ালের জাতভাই নয়, তবে বিড়ালের মতোই মাছ খেতে পছন্দ করে। বিড়ালের সঙ্গে বাঙালিদের বেশ বনিবনাও আছে। বাঙালিরা ভাত খায়, সেজন্য এক সময় বলা হত ‘ভেতো বাঙালি’। সেই সূত্রে রাওয়াল সাহেব বলতেই পারতেন, ‘মেছো বাঙালি।’ মেছো বাঘ যেমন। কিন্তু রাওয়াল সাহেব এরপর বলেছেন, ‘গুজরাটিরা মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেবেন। কিন্তু ওদের নয়। যে ভাষায় ওরা কথা বলে, তাতে মুখে ডায়াপার পরানো উচিত।’ ওরা মানে বাঙালিরা।
পরেশ রাওয়ালের বক্তব্যের সমালোচনা হয়েছে ভারতে। মেছো বাঙালিরা রেগে কাঁই। রাওয়াল অহেতুক কেন মাছের প্রসঙ্গ টানলেন, তাদের জিজ্ঞাসা। সমালোচনায় জর্জরিত রাওয়াল শেষ পর্যন্ত টুইট করে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে ক্ষমা মেগেছেন। তা ভুল হতেই পারে, আফটার অল, মেছোভেতো বাঙালি তিনি নন। সুতরাং ক্ষমার্হ। কিন্তু ‘যে ভাষায় ওরা কথা বলে, তাতে মুখে ডায়াপার পরানো উচিত’Ñএই কথার মানে কী? বাঙালিদের ভাষা কি মলমূত্র? প্রিয় পাঠক/পাঠিকাগণ, আমি আর কিছু বলতে চাই না। আপনাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা কিছু বলতে চান। হয়তো আপনাদের হাত-পাও নিশপিশ করছে। পরেশ রাওয়ালকে কাছে পেলে কিছু বাছাই করা বাংলা শুনিয়ে দিতে পারতেন। কিছু তো বলতেনই। বলুন, বলুন। তবে ওই যে, মুখে যেন ডায়াপার পরাতে না হয়!
প্রমিত হোসেন : সাহিত্য-অনুবাদক ও সাংবাদিক