জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, অন্ধকার দূর করে। জ্ঞানকে অবলম্বন করে অতীত থেকে মানুষ বর্তমানে পৌঁছেছে, ভবিষ্যতে যাবে অনেক দূর। মানুষ পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গ্রহকে খুঁজে পাচ্ছে জ্ঞানেরই কারণে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে জ্ঞানের জন্য। জীবনযাপনে সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে জ্ঞানেরই বদৌলতে। তাই জ্ঞানকে মনে-প্রাণে ধারণ করতে হবে। এ জন্য চাই কঠোর অধ্যবসায়। আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে থাকতে হবে জ্ঞানদাত্রীর আশীর্বাদ। জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী আমাদের সেই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তোলেন। তিনি জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, ললিতকলার দেবী।
জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক হিসেবে সরস্বতী দেবীর বর্ণনা রয়েছে পুরাণে, বেদে, অরণ্যকে, সংস্কৃত এবং সাহিত্যে। মহাকবি কালিদাস, শ্রীহর্ষ, ভবভূতি প্রমুখের রচনায় রয়েছে দেবী সরস্বতীর প্রশস্তি ও বন্দনা। ষোড়শ শতকের কবি কঙ্কন এবং পরবর্তীকালে মুকুন্দ রাম, সুরেন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সবাই সরস্বতী দেবীর বন্দনা করেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ললিতকলা, সংগীত, নন্দনতত্ত্ব তথা বিদ্যার প্রতীকরূপে। উল্লিখিত গ্রন্থগুলোয় এবং কবিকল্পনায় সরস্বতী শুক্লবর্ণা, বীণাধারিণী ও চন্দ্রের শোভাযুক্তা। তিনি শ্রুতি ও শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর এ কারণেই দেবীর নাম হয়েছে সরস্বতী।
ঋগে¦দে বাগদেবী ত্রয়ীমূর্তি। জ্ঞানময়ী রূপে তিনি সব জায়গাতেই আছেন। বিশ্বভুবনের প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। যোগীর হৃদয়ে সেই আলোকবর্তিকা যখন জ্বলে ওঠে, তখন জমাটবাঁধা অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যায়। ওই অবস্থায় সাধকের উপলব্ধি ঘটে অন্তরে, বাইরে সব জায়গাতেই আলো। এ জ্যোতির জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এ জ্যোতিই প্রণব, এ জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী বলেই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী। জ্ঞানের পরিধি অসীম। অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাকশক্তির প্রতীক এই সরস্বতী। তাই তিনি বাগদেবী। তিনিই বক্র ও সুমেধার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগে¦দে তাকে নদীরূপ বলা হয়েছে। সরস্বতীই প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। দেবী সরস্বতীর জ্যোতি বিভূতি ও নদী সরস্বতীর নিষ্কলুষতার সমন্বয়ে দেবী শ্বেতবর্ণা। কল্যাণময়ী নদীর তটে সাম গায়করা বেদমন্ত্র উচ্চারণে, সাধনে নিমগ্ন হতো। তাদেরই কণ্ঠে উদগীত সামসংগীত শ্রুতি-সুখকর হতো। তারই প্রতীক দেবীর করকমলে। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি-বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয়পূর্বক সাধনা করতেন ঋষিরা। ওই ভাবটি নিয়েই দেবী পুস্তকশ্রী। পরিচিত হলেন জ্ঞানের দেবী সরস্বতী হয়ে। দিনে দিনে সরস্বতী অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন।
সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী ও বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নীÑ লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদীরূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে সরস্বতী নদী ও সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার তত্ত্ব। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী = সরস (জল)+মতুন+ঙীন (স্ত্রী)। তাই সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেনÑ ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন হিন্দুরা উপাস্যদেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন, তেমনি ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।’
আমরা যে জ্ঞান এবং বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে সত্য, শিব ও সুন্দরকে পেতে চাইÑ তারই মূর্ত প্রতীক বিদ্যাদেবী সরস্বতী। আমাদের জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধিতে থাকবে না কোনো হিংসা-দেষ ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব; থাকবে শান্তির অমৃত ললিতবাণী। আর এ কারণেই সরস্বতী দেবীর মৃণ¥য়ী মূর্তিতে নেই কোনো মারণাস্ত্র, হিংস্রতার লক্ষণ ও কোনো পশুশক্তির প্রতীক; রয়েছে শ্বেত-শুভ্র বসন, জ্ঞানের মসি এবং পুস্তক। হাতে শান্তির ললিতবাণীর বীণাযন্ত্র, আছে চিরপ্রবহমান ফল্গুধারা নদী, রয়েছে হংসবাহনÑ যে জলদুধ মিশ্রণের মধ্য থেকে সারবস্তু দুধটুকু পান করে। শুভ্রতা যেমন বিশুদ্ধতার প্রতীকÑ তেমনি আমাদের মন-মানসিকতা, জীবনাচরণ, জীবনদর্শন হবে বিশুদ্ধ ও পরিশীলিত এবং চিন্তা-চেতনা হবে নিত্যসঙ্গী। এই সুশীল চিন্তা-চেতনা যেদিন ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে স্থান লাভ করবে, সেদিন মানুষ হবে সুখী এবং সমাজ হবে বিকশিত। বর্তমানে আমরা বিদ্যাদাত্রীর মৃণ¥য়ী মূর্তিকে চিন্ময়ীরূপে অর্চনা করছি। তাই আজ আমরা শ্রীপঞ্চমীতে অবক্ষয়ের হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাগদেবী সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা জানাইÑ ‘বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমোহস্তুতে।’
তুষার কান্তি সরকার : সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা