আর্থিক সংকট ও কাগজের বাড়তি দামের প্রভাব, খরচ সাশ্রয়ে কমেছে ক্যালেন্ডারের পাতার সংখ্যা
নতুন বছর এলেই বাড়ে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও শুভেচ্ছা কার্ডের চাহিদা। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি উপহার দেওয়ার প্রচলন আছে অনেক আগে থেকেই। পাশাপাশি অনেকেই বছরের শুরুতে প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে ‘নিউ ইয়ার’ কার্ড ও কাস্টমাইজড ক্যালেন্ডারও উপহার দিয়ে থাকেন। ফলে এ সময়ে বাড়তি চাহিদা মেটাতে প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন বিক্রেতারা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি আর্থিক সংকটের কারণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণ করায় এবারের মৌসুমে অর্ডার কমেছে। শুভেচ্ছা কার্ডের চাহিদাও একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। ফলে ব্যবসার মোক্ষম সময়ে খারাপ সময় পার করছে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও শুভেচ্ছা কার্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে নামিদামি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট-বড় অসংখ্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বছরের শেষদিকে শুভেচ্ছাসামগ্রী ছাপা ও তৈরিতে ব্যস্ততা বাড়ে এগুলোতে। নতুন বছরের দেয়াল ক্যালেন্ডার, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, মিনি ও পকেট ক্যালেন্ডার, বিভিন্ন ডিজাইন ও আকারের ডায়েরি, ‘নিউ ইয়ার’ শুভেচ্ছা কার্ড, পোস্টারের পাশাপাশি বিয়ের কার্ড বিক্রি নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করেন তারা। কিন্তু এবার অনেকটা অলস সময় পার করছেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী।
হ্যাপি প্রোডাক্টস্-এর ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন বলেন, এমন সময় কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পেতাম না। এ বছর অর্ডার নাই, বিক্রি নাই। বসে বসে ঝিমাচ্ছি। দিনে ১০ হাজার টাকাও বিক্রি করতে
পারছি না। এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক।
এ ব্যবসায়ী জানালেন, কাগজের বাড়তি দামের কারণে ক্যালেন্ডারের দামও পিসপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়তি এবার। দামের কারণে ১২ পাতা, ৬ পাতার ক্যালেন্ডারের বদলে ৩ পাতার ক্যালেন্ডার অর্ডার করছে বেশি। এ ছাড়া গেল বছর চাহিদা থাকলেও এবার ডেস্ক ক্যালেন্ডার, মিনি ও পকেট ক্যালেন্ডারের চাহিদা নেই বললেই চলে।
এবার মৌসুমে ৪০ শতাংশেরও বেশি ব্যবসা কমেছে বলে জানান হাবিব প্রোডাক্টসের ব্যবসায়ী মো. সেলিম কবির। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটি বড় ধাক্কা। একদিকে কাগজের দামে আগুন, আরেকদিকে বিক্রি নেই- উভয় সংকটে আছি।’ ক্যালেন্ডারের ডেলিভারি নিতে আসা এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. হানিফ সরকার বলেন, ‘গেল বছর ওয়াল ক্যালেন্ডার, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও শুভেচ্ছা কার্ড করেছি। এবার খরচ কমাতে ডেস্ক ক্যালেন্ডার ও শুভেচ্ছা কার্ড বাদ দিতে হয়েছে।’
প্রয়োজনের সময় কাগজের অভাবে কাজ ব্যাহত হয়েছে অভিযোগ জানিয়ে এশিয়া প্রোডাক্টস্-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বর-কাজের এ দুই মাসে বাড়তি দামেও ঠিকঠাক কাগজ পাইনি। ‘পিক টাইমে’ একটি সিন্ডিকেট দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা অতিরিক্ত দামেও কাগজ বিক্রি করেছে। এসব কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, ছয় পাতার ক্যালেন্ডার ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরিগুলোর দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে। ‘ওয়ান ডেট’-এর ডায়েরিগুলো এখন ৩০০ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না। গেলবার এগুলো ২০০ থেকে ২২০ টাকাতেও বিক্রি করেছি।
এদিকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা কার্ডের বিক্রি একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে বলে জানায় স্কাই প্রডাক্টস্, এবি কার্ডসহ এখানকার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তারা বলছেন, নিউ ইয়ার কার্ডের চল ধীরে ধীরে কমে গিয়ে এখন প্রায় বিলীন। বিক্রি হলেও খুবই অল্প।
আজাদ প্রডাক্টসের এজিএম মোস্তফা কামাল বলেন, অন্যদের মতো এবার আমাদের অর্ডারও কমেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১০ শতাংশ ব্যবসা কমেছে। কাগজের বাড়তি দামের কারণে পণ্যের দাম এবার বেড়েছে। যেমন- আমাদের ছয় পাতার ক্যালেন্ডারের দাম ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে।
দেশে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও নোটবুক, বিয়ের কার্ডসহ বিভিন্ন কার্ডের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এবার ৬০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে। একদিকে কাগজের দাম দেড়গুণ বাড়তি, অপরদিকে ডলার সংকটে আমদানিও কম। এ অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন।’