আমাদের নিশাত আপা তিন যুগ আগে বুয়েট থেকে পাস করেছিলেন। পাস করার পর পরই স্বামীর সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। কাতারে। দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি ঘর-সংসার নিয়েই মেতে রইলেন। চাকরি-টাকরি করলেন না। কারণ জুনিয়রদের আন্ডারে চাকরি করা সম্ভব ছিল না। এ জন্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবন্ধব সবার কাছ থেকেই নানা ধরনের বয়ান শুনে যেতে হচ্ছে বেচারাকে। এখন পুরনো সব মানুষকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সমাধান হচ্ছে না। নতুন যাদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করছেন বা মিশতে হচ্ছে, সেখানেও শান্তি নেই! প্রথমেই শুনতে হচ্ছেÑ কিছুই করেন না, বসে আছেন? আশ্চর্য!
এ রকম অনেক নিশাত আপা আছেনÑ যাদের এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে তখনÑ যখন ‘কিছুই করেন না’ বলার সঙ্গে অবজ্ঞা মিশে থাকে। নিজেকে গুটিয়ে নিতে হতে হয় তখন। স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া যায় না। মন খারাপ হয়ে যায়। কী করে তাদের বোঝাবেন যে, ‘শ্যাম আর কুল’Ñ দুটিই রক্ষা করা সব সময় সম্ভব হয় না। আরও খারাপ লাগেÑ যখন কোনো কর্মজীবী নারীই মুখের ওপর বলে বসেন, আমরা তো আর স্বামীর ঘাড়ে বসে খাই না; নিজের কামাই করা পয়সায় খাই। হাউসওয়াইফরা বাড়ি বসে শুধু কূটনামি করেন! এসব কথা নারীরাই বেশি বলে থাকেন। চাকরি করার অহং তারা সারাক্ষণই মুখে ঝুলিয়ে রাখেন! সবার কথা বলছি না। তবে বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীই এ রকম টোনেই বলে থাকেন। দেখেছি। সমস্যা এখানেই।
নারী-পুরুষের বিভাজন করার জন্য এ লেখা নয়। নারীতে নারীতে বিভাজন করার জন্যও নয়। পুরো সমাজব্যবস্থাকে বোঝার চেষ্টা না করে যে মন্তব্যগুলো করা হয়, সেগুলো থেকে বের হয়ে আসার জন্য এই লেখা। পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে সরিয়ে নতুন চোখে দেখতে শেখার জন্য এই মিনতি। নতুন ফ্যাশনে দুরস্ত হলেই তো শুধু চলবে না, আমাদের পুরনো প্রজন্মের কনসেপ্ট থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। তবেই না আধুনিক বলা যাবে, নয় কি!
প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক ও সমাজব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি পরিবার গড়ে ওঠে, একটি সুন্দর সংসার গড়ে ওঠে। একটি সুখী সংসার গড়ে উঠতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা। আমাদের সমাজে সুখী সংসার গড়ে তোলার জন্য এখনো নারীকেই বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পুরুষ ত্যাগ স্বীকার করেন না, তা বলছি না। একজন শিক্ষিত মেয়ে যখন কর্মজীবী নারী না হয়ে শুধু সংসার সামলানো অ-কর্মজীবী (!) নারী হয়ে থাকেন, তখন তাকে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়Ñ তা একমাত্র তিনিই জানেন এবং বোঝেন। না, তার যোগ্যতা নেই বলে তিনি শুধু সংসার সামলান না; সংসার সামলান নিজের পরিবারকে ডিসিপ্লিন্ড রাখতে, এলোমেলো হওয়া থেকে বাঁচাতে, আগলে রাখতে। স্ট্যাটাস অনুযায়ী এই আগলে রাখার মূল্য নির্ধারণ করে দেখুন, ঘরের প্রতিটি কাজের হিসাব করে দেখুনÑ একজন কর্মজীবী নারীর পারিশ্রমিক বা বেতন থেকে কোনোভাবেই তা কম হবে না, বেশিও হতে পারে। অঙ্ক করে শুধু একটু বুঝতে শিখুন। ভুল বুঝবেন না আগেই। আগে হিসাব করে শুধু বোঝার চেষ্টা করে নিন।
কর্মজীবী নারীর বিপক্ষে বলার জন্য এই পরিশ্রম করছি না; করছি সার্বিক দিকগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার জন্য, ট্রাডিশনাল দৃষ্টিভঙ্গি ও কথাবার্তা থেকে বের হয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি চর্চা করার জন্য। নারী-পুরুষ উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে শুধু পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর আন্দোলন করলেই হবে না! কর্মক্ষেত্রে গিয়েও কী করে একটি সংসার গুছিয়ে রাখা যাবে, শান্তি বজায় রাখা যাবেÑ এ পরিকল্পনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংসার শুরুর প্রথমেই কিংবা শুরুর আগেই পরিকল্পনা করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। না হলে হচপচ অবস্থা হবেই। বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে অনেককেই দেখা গেছে, সন্তান নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এদিকে অর্থের প্রয়োজনে চাকরিও করতে হচ্ছে!
অনেক কর্মজীবী নারীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছেÑ যাদের স্বামীরা চমৎকারভাবে সন্তানসহ পুরো সংসারটাকে নিখুঁতভাবে পরিচালনা করে আসছেন। সকাল ৮টা-৫টার চাকরি না করে টুকটাক ব্যবসা করে সন্তানদের স্কুল থেকে আনা-নেওয়া, খাওয়া-দাওয়াÑ সবকিছু সামলাতে দেখেছি পরিবারের পুরুষকেই। পুরুষের তত্ত্বাবধানেই ওই সংসার গোছানো থাকছে। এখানে নারীর একা ক্রেডিট নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে, আমি ঘরও সামলাচ্ছি; বাইরেও সামলাচ্ছি! কর্মজীবী অনেক নারীকে এমনও বলতে শুনেছি, আমাদের সন্তানরা কি মানুষ হচ্ছে না? হাউসওয়াইফ হয়ে যারা বাড়িতে আরামসে ঘুমান, তাদের সন্তানরাই শুধু ভালোভাবে মানুষ হচ্ছে? অবশ্যই না। সত্যি কথা বলতে কী, কর্মজীবী নারীদের সেসব সন্তানই ঠিকঠাক মানুষ হচ্ছেÑ যাদের স্বামী বা পরিবারে সাপোর্ট দেওয়ার মতো অন্য কেউ আছেন কিংবা স্বামী-স্ত্রী সময় ভাগ করে নিয়ে বাইরে বের হচ্ছেন কাজের জন্য।
সরকারি চাকরি বা ভালো বেতনের চাকরি করা স্ত্রীকে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত করে অনেক পুরুষ নীরবেই তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সেসবেরও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত মনে করি। আমাদের সমাজে নারীর শুধুই গৃহকর্মকে যেমন সম্মানজনক দৃষ্টিতে দেখা হয় না, তেমনি চাকরি করা নারীকেও মাথায় তুলে রাখার দৃষ্টান্ত আছে। তাদের স্বামীদের অবজ্ঞার চোখে দেখার দৃষ্টান্তও আছে। তা হলে হরেদরে তো বিষয়টি ওই একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে থাকছে, তাই না? ঘরের কাজকে ছোট নজরে দেখা! ঘর যদি ঠিকমতো পরিচালনা করা না যায় কিংবা করা সম্ভব না হয়, তা হলে দেশ ও সমাজ সুশৃঙ্খল থাকে কী করে? ছেলেমেয়েদের নিয়ে পেরেশানির সমস্যার সমাধান হবে কী করে? সন্তানদের নিয়ে বেশিরভাগ মা-বাবাকেই এখন চিন্তিত থাকতে দেখি।
নারীর ঘর সামলানোর বিষয়টি শুধু পুরুষই অবজ্ঞার চোখে দেখেন না, কর্মজীবী নারীরাও দেখেন। এখন কমবেশি সব নারীকেই চাকরির প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। দুজনের আয় ছাড়া সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়। তাই দুজনেরই বাইরে বের হওয়ার আগে সন্তানের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। সন্তান বা বাড়ির বৃদ্ধ মা-বাবাকে অনিশ্চয়তায় ফেলে রেখে যাওয়া কি সম্ভব, না উচিত? এ রকম নানা জটিলতা নিয়েই আমাদের সমাজব্যবস্থা। না আছে ভালো ডে কেয়ার, না আছে ভালো বৃদ্ধাশ্রমÑ যেখানে নিশ্চিন্তে রেখে বাইরে সুস্থমতো কাজ করতে পারে মানুষ। এই অবস্থায় অনেক শিক্ষিত নারীকেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অ-কর্মজীবী নারীর তকমা সহ্য করতে হয়।
আমার মতেÑ পরিচয়ের পর পরই কোনো নারীকেই এ প্রশ্ন করা উচিত নয় যে, আপনি কী করেন? কারণ আলাপের একপর্যায়ে তা বের হয়ে আসবেই। ওই পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধারণ করা উচিত বলে মনে করি। কোনো নারীইÑ কী নিম্নবিত্ত, কী মধ্যবিত্ত; কাজ ছাড়া সময় কাটানোর সুযোগ পান? উচ্চবিত্তদের কথা আলোচনা করছি না। এ দেশে এখনো হাতে গোনা উচ্চবিত্ত। তবে অনেক উচ্চবিত্ত ঘরের নারীকেÑ যারা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃত, তাদের বসে বসে খাওয়ার গ্লানি সহ্য করতে হয় বলে শুনেছি! সন্তান লালন-পালন করার কাজটুকু তো তারা করেন, নাকি? যদি তা না করেন, তা হলেও থাকে পরিবারকে সময় দেওয়ার বিষয়টি। সময় দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভাবার কোনো অবকাশ নেই এখন। সেটিরও অনেক মূল্য এখন। দিন যত যাচ্ছে, আমরা তা অনুধাবন করতে পারছি। তাই সব কাজেরই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
আজকাল বিদেশে থাকা বেশিরভাগ মানুষ দেশ থেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিয়ে গিয়ে সঙ্গে রাখে কেন জানেন? নিজের সন্তানদের সময় দেওয়ার জন্য, দেখে রাখার জন্যÑ যেন তারা নিশ্চিন্তে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন। এসবেরও মূল্য নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করি। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের খুব প্রয়োজন।
শুধু কর্মজীবী নারীÑ যারা ঘরে নগদ টাকা আনেন, কর্মজীবী পুরুষ নগদ টাকা ঘরে আনেন; তাদেরই মূল্যায়ন না করে একটি পরিবারকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। পরিবারে নারী কিংবা পুরুষ কার কতটুকু কনট্রিবিউশন, সেটি মুদ্রার মানেই হোক কিংবা সময়ের মানেÑ এই বিবেচনা জরুরি। পরিবারের জন্য সময় দেওয়াও যে অত্যন্ত জরুরি, এ সচেতনতা ক্রমেই মানুষ বুঝতে পারছে; ভবিষ্যতে আরও বুঝবে। তাই ‘অ-কর্মজীবী নারী’ ভাবনার বিলুপ্তি প্রয়োজন এখনই।
আনোয়ারা আজাদ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক