কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুকমার সৃষ্টির মাধ্যমে কল্যাণ ও ন্যায়ের বাণী প্রচার করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি বিদ্রোহের নেতা। বাংলার প্রকৃতির যে শক্তি, তার সুন্দরের যে আবেদন এর দেবতুল্য উপস্থাপক নজরুল। নজরুলকে সম্পূর্ণরূপে জানা বা বোঝার সামর্থ্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অনেকেরই নেই। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতে পারি। এই সামান্য জানা বা বোঝার যে চেষ্টা, বিশ্বাস করি আমাদের ক্ষুদ্র ও সংক্ষিপ্ত মনুষ্য এই জীবনে যত মহৎ কর্মে ব্যয় করা সম্ভব, নজরুলকে বোঝার চেষ্টা এর মধ্যে অন্যতম সেরা কর্ম বলে বিবেচিত হবে। নজরুল ছিলেন কল্যাণের, সুন্দরের, পূণ্যের, ন্যায়ের বাণী প্রচার করা অসাধারণ এক মানুষ। নজরুলকে যদি বুঝতে পারি, তার কর্মের স্বাদ আমরা গ্রহণ করতে পারি তা হলে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বজয়ী নজরুলের জীবনের অমৃত সুধা গ্রহণ করে পুণ্যবান হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ সম্ভব।
সামান্য হলেও বিশ্বজয়ের আকাক্সক্ষা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। নজরুলের কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিছুটা হলেও আমরা ওই আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারি। নজরুলকে যদি আমরা সঠিক মাত্রায় উপলব্ধি করতে পারিÑ তা হলে আমরা নিজেকে চিনতে পারব, মানবজীবনের রহস্য উন্মোচনে কিছুটা হলেও অগ্রসর হতে পারব।
নজরুল স্কুল বা বিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন খুব কমই। গাছের নিচে বসে তানপুরা বাজিয়ে সংগীত সাধনা করেছেন। তিনি সেই নজরুল যিনি বাংলার মাঠে-ঘাটে গান গেয়েছেন। তিনি বাউল নজরুল, বাবরিধারী নজরুল। তিনি সেই নজরুল যিনি মিছিলে গান গেয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি সেই নজরুল যিনি অর্থকষ্টে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন। তিনি অর্থের অভাবে সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের সঠিক চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেয়েছেন, কষ্টে ভুগেছেন। তিনি সন্তানের মৃত্যুদিনে তার দাফন-কাফনের জন্য অর্থ জোগানোর উদ্দেশ্যে গান লিখে উপার্জন করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি সেই নজরুল যিনি ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে দেশীয় জমিদারি, কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনি প্রচলিত ধারার কবিতা রচনার বিরুদ্ধে, চলমান ধারার গান গাওয়ার বিরুদ্ধে ও প্রথাগত লেখার রীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং নিজস্ব এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তিনি সেই নজরুল যিনি নিজে গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন, মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন।
কবি নজরুল সংগীতের জনক, সংগীতের দেবতা। তিনি সংগীতের মাধ্যমে মানবাত্মা সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। মানুষের যত চাওয়া-পাওয়া, আকাক্সক্ষা-আকুতি, দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, জীবনঘনিষ্ঠ সব উপকরণ তিনি সংগীতে ধারণ করেছেন। তিনি সংগীতে আবেদনের জন্য শব্দ তৈরি করেছেন এবং ওই শব্দ প্রয়োগ করে নতুন ভাব প্রকাশ করেছেন। এসব শব্দের অনেকটিই সাধারণভাবে বইপুস্তকে পাওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন ভাষার শব্দের মিশ্রণ তার লিখনীর মধ্যে লক্ষণীয়। অনেক শব্দই তিনি প্রথম বাংলা ভাষার সম্ভারে যুক্ত করেছেন। কবি শব্দ সংগ্রহ করেছেন, তৈরি করেছেন, ব্যবহার করেছেন। ওই শব্দগুলো নিয়েছেন লোকবাণী থেকে, পুঁথি থেকে এবং সংযোজন করেছেন নতুন নতুন শব্দমালা। বিভিন্ন মিথ ও পুরাণ, বাইবেল, গীতা, মহাভারত, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, আরবি এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি থেকে শব্দ চয়ন করেছেন। ওইসব মিথের ভাব, দর্শন, তথ্য, বক্তব্য, বাণীর উপজীব্য সংগ্রহ করেছেন। উপস্থাপনায় নজরুলের শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। পুরাণ থেকে সংগৃহীত শব্দের জাদুকরীতে পুরাণের মন্ত্রে মন আন্দোলিত হয়। তার নিজস্ব ভঙ্গিমা ও শব্দ চয়নে ভিন্ন ভাব সৃষ্টির মাধ্যমে শব্দের পর শব্দ গেঁথেছেন, তৈরি করেছেন অমর বাণী। এটি বেহিসেবি উদার মানবতাবাদী প্রকৃত সাম্যের পূজারি নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। সেটি বিশ্বে কোনো গীতিকার, কবি, সংগীতজ্ঞের পক্ষে অতীতে করা সম্ভব হয়েছে বলে জানা নেই। কারণ দ্বিতীয় নজরুল শুধু বাংলায় নয়, অন্য কোনো ভাষাভাষিদের মধ্যে জন্মেছে বলে জানা নেই। তিনিই শ্রেষ্ঠ হৃদয়গ্রাহী সংগীতের স্রষ্টা। তিনি বিশ্বজয়ী।
নজরুল মানুষের চিরায়ত আকাক্সক্ষার রহস্য উন্মোচন করে সুন্দরকে দেখার যে পথ আছে, ওই পথের নিষ্পাপ আবিষ্কারক। তিনি তো উপমার স্রষ্টা, অব্যক্ত বেদনাকে সামনে নিয়ে আসার রূপকার। তিনি তো সুপ্ত ভালোবাসাকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসার স্রষ্টা। তার এই ভালোবাসার আবেদন, এই অপ্রকাশিত বেদনা, এই স্বতঃস্ফূর্ততা ও মানবিকতার আবেদন এত বড় যেটি কোনো একক বা সংখ্যার পরিমাপে পরিমাণ করা সম্ভব নয়। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ গতীশীল শক্তি, আলোর গতির চেয়েও শক্তিধর। তিনি বলেন ‘তিমির বিদারী, অলখ বিহারী।’ স্রষ্টার যে অবয়ব লোকালয়ে আসে, সেটি তো বিশ্বকে সম্মোহিত করার শক্তি নিয়ে আসে। অন্ধকার ভেদ করে আলোর ভেলায় চরে যে দেবতা আসে, তার আবেদন প্রলয়ঙ্করী। যে কাক্সিক্ষত আত্মা আসে, ওই আত্মার আবেদন অফুরন্ত ও অনন্ত। এ আত্মাকে কোনো প্রচলিত চিত্রে রূপ দেওয়া যাবে না, কোনো দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মাপা যাবে না, হাত-পায়ের বর্ণনায় এঁকে চিহ্নিত বা আকৃতি দেওয়া যাবে না। এ আত্মার আবেদন অনেক যেটিকে একমাত্র নজরুলের আত্মার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলেই সম্ভব উপলব্ধি করা। কিন্তু অন্য কোনো মাপকাঠিতে মাপা সম্ভব নয়। নজরুল ছাড়া অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই এর সাদৃশ্য সম্ভব নয়। কারণ এটি যে নজরুলের নব সৃষ্ট দর্শন। প্রচলিত মন আর শক্তি দিয়ে ভাবলে এটিকে হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। নজরুলের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে যদি আমরা কখনো নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করে, নিবেদন করে সেটি গ্রহণ করা বা বোঝার চেষ্টা করি তা হলেই শুধু এটি অনুভব, অনুধাবন কিংবা উপলব্ধি করা সম্ভব। নজরুল যে অমর-অমৃত বাণী রেখে গেছেন, ওই বাণীকে বোঝা বা আস্বাদন করা সম্ভব, অন্যাথায় নয়। তাই নজরুলকে আমরা বলব মানুষের হৃদয়জয়ী, জীবনজয়ী, সৃষ্টিজয়ী কবি ও সংগীতজ্ঞ। কোটি মানুষের দৃষ্টিতে যতটুকু দৃশ্যমান হয়, নজরুল একা তা দেখেছিলেন। কোটি মানুষের অনুভূতিতে তিনি একা অনুভব করতে পেরেছিলেন। কোটি মানুষের হৃদয় যা কল্পনা করতেও ব্যর্থ হয়, নজরুল একা তা কল্পনা করেছেন। অনেক মানুষ একত্রে সাধনা করে যে শব্দ চয়ন করতে ব্যর্থ হয়, নজরুল একাই তা করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সংগীতের জগতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন। তার সংগীত প্রতিভা ছিল অপরিমেয়, অতুলনীয়, অপরিসীম ও ঐশ্বরিক। বাংলা সাহিত্যে নজরুল সর্বাধিক গান রচয়িতা। প্রায় চার সহস্রাধিক গান তিনি রচনা করেছেন। পালাগান, পল্লীগীতি, লোকসংগীত, বাউল, দেশের গান, গজল, হামদ-নাথ, শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তনসহ তার বহুমাত্রিক গানের সমাহার সমভাবে দেখতে পাওয়া যায়। তার বিচরণ ঘটেছে বাংলা সংগীতের সব অঙ্গনে। সংগীত সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী। যদিও সংগীতে তিনি ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাগ্রহণের সময় বা সুযোগ কোনোটিই পাননি, তবুও সংগীতের নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। তিনি এক অকৃত্রিম ধারা তৈরি করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সংগীতের সুর, তাল, লয় নিয়ে খেলা করেছেন; পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন রাগের। তিনি হিন্দুস্থানি রাগের ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি, নিজেও ১৭টি রাগ সৃষ্টি করেছেন এবং দক্ষিণ ভারতীয় রাগের ব্যবহার করেছেন তার গানে। তার গানে প্রায় ১৬টি হিন্দুস্থানি রাগের ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া নানা রাগের মিশ্রণও ঘটিয়েছেন। রাগসংগীত সম্পর্কে স্পষ্ট ও সম্যক জ্ঞান না থাকলে রাগের মিশ্রণ ঘটানো সম্ভবপর নয়। তার রচিত গানের শিরোনামে রাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি গান রচনা করেছেন, স্বরলিপি তৈরি করেছেন, সুর দিয়েছেন, নিজে গেয়েছেন আবার মঞ্চস্থ করেছেন। তিনি সংগীতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি অকৃত্রিমতা নিয়ে আগ্রহীদের সংগীত শিখিয়েছেন, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ওস্তাদ হিসেবে অনেককে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি লোকসংগীত, দেশাত্মবোধক গান, লেটোগান, বিদ্রোহের গান, প্রেমের গান, সাম্যের গান, ভজন, কীর্তন, শ্যামা, গজল, হামদ, নাথ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপযোগী গান রচনা করেছেন যার অনেকটিই কালোত্তীর্ণ অমর সৃষ্টি হিসেবে পূজনীয় হচ্ছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসকে ধারণ করে চলমান রয়েছে। তিনি নৃত্যের তালে তালে উপস্থিত সংগীত রচনা ও সুরারোপে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার অতিপ্রাকৃত মহাশক্তিধর আধ্যাত্মিকতা, সৃষ্টির রহস্যের গানের আবেশ সদা প্রবাহমান; এক অজানা আকর্ষণে শ্রোতাকে বিমোহিত করে রাখে। কীর্তন, শ্যামা, ভজন গানের বাণী রচনা ও শব্দ প্রয়োগের মুনশিয়ানা এত শক্তিধর ছিল যে অমূর্ত কৃষ্ণকে মুহূর্তের মধ্যে দর্শক-শ্রোতার চোখের সামনে অকল্পনীয় এক মূর্তিমান মহাশক্তিধর মানবমূর্তিতে উপস্থাপন করত। ইসলামি গান, গজল, হামদ-নাথে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার এই হৃদয়হরা ধর্মীয় গানের সম্মোহনী শক্তি হতাশ মানবহৃদয়ের মধ্যে আশার আলো ছড়িয়ে দেয়।
এই যে বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দ প্রয়োগ, সুর, তাল, লয়, রাগের ব্যবহার নজরুলের সংগীতে আমরা দেখতে পাই- এর উদাহরণ শুধু বাংলা ভাষায় নয়, অন্য কোনো ভাষাতেও সংগীতের এই বাণী ও আবেদন খুঁজে পাওয়া কঠিন। নজরুল অতুলনীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সংগীতের মহাসমুদ্র নির্মাণের জাদুকরী স্রষ্টা। তিনিই তো বাংলা গানে দেবতুল্য সংগীত স্রষ্টা। জন্মদিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়