বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি এ বছরের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পূর্তি উৎসব পালন করছে। এ দলটি এখন নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়েও অহঙ্কার করতে পারে। ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত দেশটি এখন নতুন উচ্চতায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার বঞ্চনা এবং বিশেষ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপেক্ষার পটভূমিতে দলটির জন্ম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার মাস যেতে না না যেতেই কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পাট চুকিয়ে অচেনা শহর ঢাকায় চলে আসা তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। বিস্ময়কর দূরদৃষ্টি ছিল তার! পাকিস্তান হতে না হতেই তিনি বুঝে যান- বাঙালিদের দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। এটি মোকাবিলায় দরকার বলিষ্ঠ সংগঠন। ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে বের হয়ে এসে গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। সাম্প্রদায়িকতা তার পছন্দ ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশের আবহাওয়া চিন্তা করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ রাখা হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগবে না’ [পৃষ্ঠা ৮৯]।
পরিহাসের বিষয়, যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, দলকে আম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অন্যতম উদ্যোক্তা, যিনি ১৯৫৭ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে শর্ত দিয়েছিলেন- প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্যপদ ও দলের সাধারণ সম্পাদকের পদের একটি অবশ্যই ছাড়তে হবে, যিনি ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ইস্যুতে দ্বিমত পোষণ করে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন; তিনি ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচিকে ‘সিআইএ প্রণীত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে যখন এ কর্মসূচি পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্র লাহোর নগরীতে উপস্থাপন করেন; তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুুব খান, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এবং এই চক্রের উপদেষ্টা-পরামর্শদাতারা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায়- এ তো পাকিস্তান ভাঙার কর্মসূচি!
বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুই বাঙালির স্বার্থের প্রতিনিধি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল ১৬৭টি আসন পেয়ে যায় (এর মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ৭টি)। ৩৩ বছর বয়সেই বঙ্গবন্ধুর দলের পূর্ব পাকিস্তান কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু বাংলার তিন প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছে তিনি অপরিহার্য রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ভিন্নধারার রাজনীতিক নেতা। সোহরাওয়ার্দী সাহেব অভিজাত পরিবার থেকে এসেছেন, উচ্চশিক্ষিত, আইন পেশায় দক্ষ, জীবনযাপনে পাশ্চাত্যের বিপুল প্রভাব। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ‘ভাসানচরের পীর বংশের’ সন্তান, আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া তেমন নেই, কৃষক-মজুরদের স্বার্থে আপসহীন ও মজলুম জননেতা হিসেবে অভিহিত হন। তার একান্ত অনুগামী ও গুণমুগ্ধদের মধ্যে অভিজাত পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি পদে থাকলেও বেশিরভাগ সময় থাকতেন টাঙ্গাইলের কাগমারী-সন্তোষ বা জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে।
পঞ্চাশের দশকে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে না থাকলে ঢাকায় বসবাস করতেন কিংবা ছুটে যেতেন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দলের কাজে। পাকিস্তানের প্রথম ১২ বছরের মধ্যে ৪ বছরের বেশি সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। ষাটের দশকেও বারবার তাকে কারাগারে কাটাতে হয়। সবচেয়ে দীর্ঘ কারাবাস ছিল ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ সময়ের বড় অংশ কেটেছে ক্যান্টনমেন্টে। এর পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত তাকে রাখা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে।
কারাগারের বাইরে থাকার সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকা কেন্দ্র করে দলের দৈনন্দিন কর্মকা- পরিচালনা করেছেন। এর পাশাপাশি নিয়মিত জেলা-মহকুমা সফর করেছেন। দলের দুই প্রবীণ ও জননন্দিত নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক সব বিষয়ে যে তিনি একমত ছিলেন, এটি বলার উপায় নেই। কখনো কখনো দ্বিমত প্রকাশ্য হয়েছে। কিন্তু দুজনের কাছেই তিনি সমান প্রিয়। দুজনই নানা কাজে তার ওপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখেন। আবার মওলানা ভাসানি ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যেও বিভিন্ন ইস্যুতে মতপার্থক্য ছিল বিস্তর।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের প্রতি প্রথম দিকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করছিলেন। তার শঙ্কা ছিল- পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক চক্র ও সেনাবাহিনী এটি মেনে নেবে না। তরুণ বঙ্গবন্ধু তাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলতে সম্মত করাতে পারেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালের ২৯ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান যখন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার প্রদেশের বিদ্যালয়গুলোয় উর্দুকে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করার হীন প্রচেষ্টা হতে বিরত না হলে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু বর্জন করা হবে। এ জন্য প্রত্যক্ষ আন্দোলনও শুরু করা হবে।’ ১১ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে লেখা চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কিছু কাজ নিয়ে স্পষ্ট অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু বয়কটের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার সমালোচনা করে বলেন, এ ধরনের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ঘোষণার কোনো অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। তোমরা বাংলার জন্য দাবি জানাতেই পারো। কিন্তু উর্দুকে আক্রমণ করবে না। শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নেতা মেনে এসেছেন ওই চল্লিশের দশক থেকে। কিন্তু ১৯৫৩ সালেই তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমন মতবিরোধ! তরুণ মুজিবের কর্মকা-ে স্পষ্ট যে, তিনি ‘বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে চলেছেন।’ তার রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সেটি বুঝতে সমস্যা হয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে আওয়ামী লীগ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল বলেই আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর সামরিক শাসনামলে তারাই ছিল প্রধান ও বলা যায় একক প্রতিপক্ষ। কিন্তু এই প্রতিপক্ষ যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী ও সৃজনশীল নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করে তুলবে- সেটি তারা ভাবতে পারেনি। স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা এবং তাদের দল আওয়ামী লীগ কতটা প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল, সেটি প্রথম স্পষ্ট হয় ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের কবলে এই ভূখণ্ড। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি-৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবন কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছে বিকল্প প্রশাসন। ইয়াহিয়া খান-টিক্কা খানের হুকুম নয়, জনগণ পালন করেছে ৩২ নম্বরের নির্দেশ।
মহাত্মা গান্ধী শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। কিন্তু বিকল্প প্রশাসন চালু করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর একসঙ্গে দুটি কাজই করেছেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই আমাদের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা চূড়ান্ত। ২৫ মার্চ নিষ্ঠুর গণহত্যার তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথগ্রহণ করেন। স্বল্প সময়ে এ সরকার লাখো তরুণকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্রসজ্জিত করে। তারা নাস্তানাবুদ করতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। একই সঙ্গে এ সরকার ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীর খাদ্য-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে। সরকার গঠনের দেড় মাস যেতে না যেতেই বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব শিল্প-কলাকুশলী দিয়ে চালু করে স্বাধীন বাংলাকেন্দ্র। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করে পরিকল্পনা সেল। মুক্তিযুদ্ধকালে কূটনৈতিক অভিযান পরিচালনাতেও বাংলাদেশ সরকার ছিল সফল। ভারতের সঙ্গে মিলিতভাবে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী- যাদের প্রবল আক্রমণে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগী ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিল, সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য সামনে রেখেছে এবং এতে সফল হয়েছে। ১৯৭১ সালে বর্তমান পাকিস্তান ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে ওই পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। বিশ্বব্যাংক অন্যায় অভিযোগ তুলে সরে দাঁড়ানোর পর নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কোনো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ এভাবে বিশ্বব্যাংক কিংবা পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এটি করে দেখিয়েছে। এখানেই দলটির অনন্য কৃতিত্ব। অভিবাদন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।
অজয় দাশগুপ্ত : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক