অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অর্থনীতির চার সূচকে উন্নতি করে বাংলাদেশ। এই উন্নতিকে সরকারের পক্ষ থেকে আশার আলো দেখলেও শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদরাও এই ধারাকে অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এই উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গেল মাসে আমদানি কমেছে, রপ্তানি আয় বেড়েছে, রেমিট্যান্সেরও প্রবৃদ্ধি হয়েছে,
মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমেছে। অর্থনীতির এই চার সূচকে কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আশার আলো দেখছে সরকার। অন্যদিকে লোডশেডিং, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশও বাইরে নয়। আছড় পড়েছে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা ক্ষতি হলেও সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে আর কিছু দিন অটল থাকারও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। তবে এই মন্দা বেশি দিন থাকবে না বলেও আশাবাদী বিশিষ্টজনরা।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কমে লকডাউন উঠে গেলে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক কার্যক্রম ঘুরে দাঁড়াতে থাকে; আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও গতিশীল হতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশও নানামুখী চাপে পড়ে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। মোট ৩৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। আর রেমিট্যান্সও ১৪ মাস পর ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছর যেখানে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল; সেখানে জুলাইয়ে ২১০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি।
আমদানি ব্যয় ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বিশেষ করে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়। মূল্যস্ফীতির পারদ বেড়ে ৯ বছরের সর্বোচ্চে পৌঁছায়। হঠাৎ করে কমে আসে রেমিট্যান্স। তবে গত অর্থবছরজুড়ে স্বস্তি দিয়েছে রপ্তানি আয়।
গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি এবং দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি দেখা দেয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে হয় ৯৫ টাকার কাছাকাছি।
এমন অবস্থায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্যোগ এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে নেওয়া প্রণোদনা ও শর্ত ছাড়ের কিছুটা সুফল মেলে নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে। টানা ছয় মাস বাড়ার পর জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা জুন পর্যন্ত টানা বেড়ে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়।
একই সঙ্গে ডলার সাশ্রয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নানা পদক্ষেপে এক মাসের ব্যবধানে জুলাইয়ে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ। জুনের তুলনায় প্রায় ২৪৯ কোটি ডলারের এলসি খোলা কমেছে। জুনে যেখানে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, তা জুলাইয়ে নেমে আসে প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে।
এসব এলসির পণ্য দেশে আসবে আগামী মাসগুলোতে। তখন আমদানি ব্যয় মেটাতে আগের চেয়ে কম বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে। এটি ডলার সংকট কমাতে কিছুটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতিতে নানামুখী সংকটের মধ্যেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অর্থনীতিতে ভালো কিছু হওয়ার আশা প্রকাশ করেন। অর্থমন্ত্রী আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে অর্থনীতিতে গতি তৈরি হবে জানিয়ে তা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ‘ভালো খবর’ আসছে। বৈশ্বিক সংকটে নানামুখী চাপের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি।
রউফ তালুকদার বলেন, চাহিদা নিয়ন্ত্রণে আমদানি পর্যায়ে কড়াকড়ি ও নজরদারি বাড়ানোয় জুলাই মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, গত কয়েক মাস ধরে যা ৭-৮ বিলিয়নের ঘরে ছিল। এভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুফল আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই অর্থনীতিতে ভালো খবর আনবে।
চাহিদা নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণ মূলত বৈশ্বিক সংকট। আমদানি খরচ কমিয়ে আনতে ৩০ লাখ ডলারের বেশি অর্থের এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগাম তথ্য নিচ্ছে। তাতে বেশ কিছু এলসি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেই হারে না বাড়ায় দেখা দিয়েছে সংকট। ডলারের বিনিময় হার পৌঁছেছে রেকর্ড পর্যায়ে।
বিনিময় হার নিয়ে গভর্নর বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে ডলার আয় ও খরচ হয়ে যায়। তার ওপর ভিত্তি করেই দর নির্ধারণ হচ্ছে।
এদিকে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আনায় জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে, যেখানে আগের মাসে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ডলার সরবরাহ বাড়াতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগে সুফলও মিলতে শুরু করেছে। গত জুলাইয়ের শেষে দেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ, আর রেমিট্যান্সে হয়েছে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
তবে অর্থনীতি যে চাপের মুখে আছে, সে কথা স্বীকার করে গভর্নর বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো- সার্বিকভাবে মানি সাপ্লাই (অর্থ সরবরাহ) কম; অন্যান্য দেশে যেখানে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৮৮ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত, সেখানে আমাদের দেশে ৪২-৪৩ শতাংশ।
মানি সাপ্লাই কম হওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে তারল্যের ক্রাইসিস দেখা দেয়। আমরা এখন সুদহার বাড়ালে বেসরকারি খাতে মানি সাপ্লাই আরও কমে যাবে। আমরা মানি সাপ্লাই বাড়ানোর পক্ষে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বিশ^ অর্থনীতি কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশ^বাজারে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তার প্রভাব দেশের বাজারেও পড়েছে। আমদানি কমেছে, সেটা ভালো খবর, তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাহলে সেটা ভালো খবর হবে না।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি আয় বাড়লেও প্রবৃদ্ধি কমেছে। রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। রেমিট্যান্সের বিষয়ে তিনি বলেন, রেমিট্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী পাঠাতে হবে। যেসব কর্মী বিদেশে যায় তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। ফলে তারা আয় কম করে। দেশে রেমিট্যান্সও কম পাঠায়।
তিনি বলেন, চার সূচকের উন্নতি ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ হবে। যদি উৎপাদন কমে যায়, রপ্তানি কমে যায়। এ ছাড়া যদি বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে বিদেশি ক্রেতারা পোশাক কেনা কমিয়ে দেবে। তাহলে রপ্তানিও কমে যাবে। বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন আমাদের সময়কে বলেন, অর্থনীতির মূল ধারা স্বস্তির দিকে ফিরে আসলে সংকট থাকবে না। বর্তমান সংকট বাংলাদেশের তৈরি না। এই সংকট বিশ্ব্যাবপী। সব দেশেরই সমস্যা হচ্ছে। আমাদেরও মেনে নিতে হবে। তবে এই সংকট বেশি দিন থাকবে না বলেও আশাবাদী তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সবাইকে একসঙ্গে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। আপদকালীন ক্ষতি সবাইকে মেনে নিতে হবে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগকে সবাইকে মেনে নিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্যাক্স না বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমেছে এটা ভালো খবর। পণ্যের দাম বাড়া-কমা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও কমবে, এটাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই মাসে রেমিট্যান্স বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- কোরবানির ঈদ। এই ঈদকে কেন্দ্র করে অনেকেই পরিবারের খরচের জন্য দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছু দিন সময় লাগতে পারে বলেও মনে করেই এই ব্যবসায়ী।
সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রপ্তানি কিছু কমার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এটা প্রতিবছরের চিত্র। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর একটু অর্ডার কম হয়। আশা করা যায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, সবারই সমস্যা হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ। সব কিছু মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। তার পরেও সরকারের উদ্যোগকে মেনে নিতে হবে। এই সংকট হয়তো বেশি দিন থাকবে না। আশা করা যায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।
এদিকে দৈনিক কর্মঘণ্টার একটা বড় সময় লোডশেডিং থাকার কারণে সংকটে পড়ার কথা উঠে আসে গত বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত এক আলোচনায়। অনুষ্ঠানে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদ বলেন, আমরা খুব সংকটের মধ্যে আছি। এলসিগুলো শিপমেন্টের একটা নির্ধারিত তারিখ রয়েছে। এভাবে লোডশেডিং হতে থাকলে, কারখানা বন্ধ রাখতে হলে আমরা অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। আমরা জানি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ডিজেল ও এলএনজির দাম সমন্বয় করে হলেও যেন লোডশেডিং সমস্যার সমাধান করা হয়। জ্বালানির কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি উত্তপ্ত হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সিরামিকস ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আজিজুল হাকিম বলেন, সিরামিক শিল্পের মেশিনারিজগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। এখানে ৩৬৫ দিন গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাগে। কিন্তু গ্যাসের সংকটের কারণে প্রতিদিনই আমাদের সুইচ অন-অফ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এই খাত রুগ্ন শিল্প হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সিরামিক কীভাবে সারভাইব করব সেই নির্দেশনা দরকার।