সকল অর্থেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক নান্দনিক ব্যক্তিত্ব। রূপবান এক দীঘল পুরুষ। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের মতোই। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই দীঘল পুরুষকে তার প্রিয় দেশবাসী থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে একদল বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু তিনি যে রয়ে গেছেন বাঙালির নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। রফিক কবি আজাদ ঠিকই বলেছেন,
“তাঁর রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে/সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ/তাঁর ছায়া দীর্ঘ হ’তে হ’তে/মানচিত্র ঢেকে দ্যায় স্নেহে, আদরে/তাঁর রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে-/তাঁর রক্তে সব কিছু সবুজ হয়েছে।”/(রফিক আজাদের ‘এই সিঁড়ি’ কবিতা থেকে)
শুরু থেকেই নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা তার রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল। জমিদারি নিষ্পেষণের হাত থেকে পূর্ববাংলার কৃষকের মুক্তির আকাক্সক্ষায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন তিনি। কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করার বিরোধিতা করে গেছেন সব সময়। সেজন্যই তিনি হতে পেরেছেন বিশ্ববন্ধু।
‘ভ্রান্ত প্রত্যুষ’ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা শুরু করেছেন একেবারে গোড়াতেই। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং পাকিস্তানি অপশাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয় ছাড়াও বহু আন্দোলনে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নকে সামনে রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানের গণপরিষদে বাঙালির অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে সদা সোচ্চার থেকেছেন। দুই দফায় মন্ত্রিত্ব পেয়ে পূর্ববাংলায় অর্থনৈতিক বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। এ লক্ষ্যে বরাবরই আপসহীন থেকেছেন, ফলে তাকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে।
বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রামগুলোকে শুরু থেকেই তিনি বৃহত্তর মুক্তির সোপান হিসেবে দেখেছেন। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। ... আমরা কথা বলার অধিকার চাই, শোষণমুক্ত সমাজ চাই।’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ (ঢাকায় আরমানিটোলার জনসভায়)]। বাঙালির মুক্তি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের আকাক্সক্ষাগুলোকে যথাযথভাবে ধারণ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন বলেই ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু ক্রমেই অন্যতম প্রধান জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলেই রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আগেই বলেছি অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের ইতি টানতে স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে বঙ্গবন্ধু সামনে আনেন ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি। বাঙালির সেই ‘মুক্তির সনদে’ ছিল :
এক. পাকিস্তান হবে একটি ‘ফেডারেশন’ বা যুক্তরাষ্ট্র।/দুই. কেন্দ্রের ক্ষমতা কেবল দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকবে।/তিন. পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য আলাদা কিন্তু বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করা হবে।/চার. কর ও শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যের কাছে ন্যস্ত থাকবে।/পাঁচ. প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাব আলাদা করা হবে।/ছয়. পূর্ববাংলার জন্য আলাদা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠিত হবে।
১৯৫৮ সকালে সামরিক শাসনামলে দুর্নীতি মামলা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে। যা বিচারে টেকেনি। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে পূর্ববাংলার নয়া উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ছিল তার অপরাধ।
নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর গণমুখী অর্থনৈতিক সংবেদনশীলতা থেকে আসা ছয় দফাই গড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ। স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নেই- ছয় দফা দাবিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছয় দফায় জনসমর্থনে ভীত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় অপশাসকরা। ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পায়। নির্বাচনে জেতার পরও ক্ষমতা না পাওয়ায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নিশ্চিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। সুচিন্তিত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অভিযাত্রা বেগবান করতে তিনি প্রণয়ন করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮)। উদ্দেশ্য ছিল কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য নিরসন। লক্ষ্য ছিল প্রবৃদ্ধির হার ৩ থেকে ৫.৫% উন্নীতকরণ। আরও লক্ষ্য ছিল নিত্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমাতে চেয়েছিলেন তিনি (৬২ থেকে ২৭%)। আমদানি নির্ভরতা কমাতে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধোত্তর বাস্তবতার নিরিখে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারই ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল কথা।
তিনি মনে করতেন ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’ তাই সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কৃষিকে একদিকে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যমুক্তির উপায়, অন্যদিকে শিল্প বিকাশের পেছনের শক্তি (কাঁচামালের সরবরাহ, শিল্পপণ্যের চাহিদা তৈরি) হিসেবে দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই ২২ লাখ কৃষক পরিবারের পুনর্বাসন ও ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নেন। ৪ মিলিয়ন ডলার কৃষিঋণ বিতরণ করেন তিনি। কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য ও রেশন সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর বাইরেও কৃষি গবেষণায় অগ্রাধিকার, বিএআরই, বিনা, বার্ক এবং বিআরআরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সিভিল সার্ভিসে যুক্ত করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা করেছিলেন। ৪৩ হাজার সেচ যন্ত্র স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের মধ্যে ৩৩% সেচের আওতা বৃদ্ধি, ৭০% রাসায়নিক সার ব্যবহার বৃদ্ধি, ২৫% উন্নত বীজের ব্যবহার বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছিলেন।
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনির্ভরতা থেকে ক্রমান্বয়ে ব্যক্তি খাতের বিকাশের পক্ষে ছিলেন তিনি। শুরুতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে শিল্পের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যক্তি খাতের কার্যকর বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টির প্রস্তাবনা ছিল। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের সীমা ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটিতে নেওয়া এবং ১৩৩টি পরিত্যক্ত কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয়। শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নেও ছিল তার প্রখর দৃষ্টি।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজ ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন। আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন, খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পার্সেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই বক্তৃতা করি। ... আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে।’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুুুজিবুর রহমান (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫)]
আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু সময়োচিত মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর মুদ্রা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে গ্রেট ব্রিটেন থেকে উন্নত মানের নোট ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে বাজারে নকল নোট ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল। আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য- একশত টাকার নোট ‘ডিমনিটাইজ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রা (সে সময়ে পাউন্ড স্টার্লিং)-এর সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নমনীয় করে ফেলেছিলেন যাতে বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দেওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সঠিক পথেই এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। মাত্র চার বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তাকে শারীরিকভাবে হারিয়ে বেপথু হয়েছিল অর্থনীতি। ১৯৭৫-এর পর্যায়ে ফিরতে সময় লেগেছিল আরও ১৩ বছর।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আশাবাদী নেতা। তাই তো তিনি বলেছেন, ‘এই দিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি, ইনশাআল্লাহ এদিন থাকবে না। তোমরা আজকে সুযোগ পেয়ে জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে দাও। জিনিসের দাম বাড়িয়ে দাও। আর তাই আমাদের কিনতে হয়। আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না ...’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা, ২৬ মার্চ ১৯৭৫)।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বর্তমান সংকট উত্তরণেও পথ দেখিয়ে চলেছে। বহু বাধা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি আমরা। করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ দেশের চেয়ে ভালো করছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর দিয়ে যাওয়া লড়াকু মনই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি। সেই পুঁজি ব্যবহার করেই এই সংকট উত্তরণে আমরা সফল হবো বলে বিশ্বাস করি।
ড. আতিউর রহমান : লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর