আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু তার জীবনের ১৪টি বছর কারাগারেই কাটিয়েছেন। পাকিস্তান সরকারের আমলে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন। এর আগে ব্রিটিশ আমলে স্কুলে পড়ার সময় এক সহপাঠীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি ৭ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি টানা দুই বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান। ২৭ ফেব্রুয়ারি স্ট্রেচারে করে তাকে জেলখানা থেকে তার এক আত্মীয়ের বাসায় নেওয়া হয়। অনশন ও কারাগারের শোচনীয় অবস্থার কারণে জেলখানায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের স্বপ্নের সম্রাট নবম পর্বে তার কিছু আমরা উল্লেখ করেছি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মাদারীপুর কয়েকদিন থেকে শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। নদীপথে যাওয়ার সময় তার ভক্তরা তীরে জড়ো হয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। ডাক্তার তাকে বাড়িতেই বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। বেশিদিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। স্ত্রী-সন্তানদের সাহচার্য ত্যাগ করে একটু সুস্থ হয়েই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, তিনি ঢাকায় ফিরেছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ এপ্রিল রাত ১১টায়। ঢাকায় এসেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকা-ে। এর মধ্যে ২৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী পত্র মারফত পরামর্শ দিয়েছেন, বাংলা প্রাদেশিক রাষ্ট্র ভাষা হোক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এই পরামর্শ গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে একমত হয়ে অনেক কর্মী সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে অমত প্রকাশ করেন। ‘তাদের মূল দাবি ছিল বাংলাও যেন একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়’ (‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, সম্পাদনা : শেখ হাসিনা, হাক্কানী পাবলিশার্স, ভলিউম-২, পৃষ্ঠা-১৬৮)। বাঙালি জাতির স্বার্থে তিনি তার রাজনৈতিক গুরুর সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করতে কখনই দ্বিধা করেননি।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচারে গুলি তো চলেই, এর সঙ্গে চলে সমানে ধরপাকড়। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তাকে দেওয়া হতো ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ খেতাব। এর ফল হতো জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার ও বিনাবিচারে কারাভোগ। শেখ মুজিবকে বারবার এই নিপীড়নমূলক আইনে বন্দি রাখার ঘটনা ঘটেছে। কেননা তিনি উচিত কথা বলতে একদম কাউকে ছাড় দিতেন না। কেমন ছিল কারাগারে নিরাপত্তাবন্দিদের অবস্থা? ১৯৫২ সালের ৩০ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকা শেখ মুজিবের একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কারাগারে নিরাপত্তাবন্দিরের শোচনীয় অবস্থার কথা জানা যায়।
আওয়ামী লীগ নেতার বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকারের স্বরূপ উদ্ঘাটিত
ঢাকা, ২৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতি প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারগুলোর অবস্থা বর্ণনা করে বলেনÑ ‘এ সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। যে সমস্ত নিরাপত্তাবন্দি বছরের পর বছর ধরিয়া বিনাবিচারে জেলে পচিতেছেন, ব্রিটিশ আমলে যে সমস্ত সুবিধা দেওয়া হইতো, তাহাও তাহারা পান না। এই সমস্ত বন্দির অধিকাংশই আসিয়াছেন মধ্যবিত্ত পরিবার হইতে : কোনও রকম ভাতার ব্যবস্থা না থাকায় ইহাদের উপরে নির্ভরশীল ব্যক্তিদের অবস্থা যে কতখানি শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে, সহজেই তাহা অনুমান করা চলে’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭১)। এর সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে প্রকাশিত বর্ণনারÑ “পাকিস্তানের নাগরিকদের বিনাবিচারে বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছয় মাস পর পর একটা করে হকুমনামা সরকার থেকে আসে। ইংরেজ আমলেও রাজনৈতিক বন্দিদের কতগুলি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো, যা স্বাধীন দেশে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়চোপড়, ঔষধ, খবরের কাগজ, খেলাধুলার সামগ্রী, এমনকি এদের ফ্যামিলি এলাউন্সও দেওয়া হতো ইংরেজ আমলে। নূরুল আমিন সাহেবের মুসিলম লীগ সরকার সেসব থেকেও বন্দিদের বঞ্চিত করেছেন। সাধারণ কয়েদি হিসেবে অনেককেই রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দিরা দেশের জন্য ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছেন, এ কথা স্বীকার করতেও তারা আপত্তি করছেন। এমনকি মুসিলম লীগ নেতারা বলতে শুরু করেছেন, বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেল খাটলে সেটা হতো দেশ দরদির কাজ। এখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেল খাটছে যারা, তারা হলো ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। এদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। ইংরেজের ‘স্যার’ ও ‘খান বাহাদুর’ উপাধিধারীরা সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়ে আজ এ কথা বলছেন। জনাব লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এদের আমলে যে নির্যাতন ও নিপীড়ন রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর হচ্ছে, তা দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে কোনোদিন হয় নাই। রাজনৈতিক বন্দিরা যাতে কারাগারের মধ্যে ইংরেজ আমলের সুযোগ-সুবিধাটুকু পেতে পারে, তার জন্য অনেক দরখাস্ত, অনেক দাবি করছে। কিন্তু কিছুতেই সরকার রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে তাদের অনশন করে, যার ফলে ঢাকা জেলে শিবেন রায় মারা যান। যারা বেঁচেছিলেন, অনেকের স্বাস্থ্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পরে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। অনেকের মাথাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তাদের অবস্থা কী হয়েছিল, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারবেন না” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ জুন ২০১২, পৃষ্ঠা ১৭১-১৭২)।
পাকিস্তান সরকারের আমলে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকা-ের দিনটি কলঙ্কময় হয়ে আছে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল কামরাবন্দি অবস্থায় গুলি করে ৭ জনকে হত্যা করা হয়, আহত হয় অনেকে। সরদার ফজলুল করিম এ ঘটনা স্মরণ করে লিখেছেন, “রাজশাহী জেলে অন্য বন্ধুদের কাছে আমি খাপড়া ওয়ার্ডের কাহিনি শুনেছি। রাজশাহী জেলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে যে হত্যাকা-টা সংঘটিত হয়, তাকে আমরা বলি ‘খাপড়া হত্যাকা-’। রাজশাহী জেলের সাধারণ কয়েদিরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। পলিটিক্যাল প্রিজনারদের রাখা হয়েছিল খাপড়া ওয়ার্ডে। খাপড়া ওয়ার্ডটা ছিল একটা বাংলোবাড়ির মতো এবং এ বাড়িটার চারিদিকে অনেকগুলো জানালা ছিল। পলিটিক্যাল প্রিজনাররা এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাধারণ কয়েদিদের সমর্থনে আমাদের কিছু করা উচিত। সাধারণ কয়েদিরা যদি অনশন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তবে আমরাও অনশন করব। সে সময় রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তার নাম ছিল মি. বিল। ও অর্ডার দেয় যে, কয়েদিদের মধ্যে যারা নেতা আছে, তাদের আলাদা করো। আলাদা করার দিনটিতে মি. বিল যখন তার দলবল অর্থাৎ ডেপুটি জেলার ও অন্যদের নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডের ভিতরে অর্থাৎ সেই বাংলোবাড়িতে ঢুকে, তখন পলিটিক্যাল প্রিজনাররা বাংলোর দরজাটি বন্ধ করে দেয়Ñ যাতে জেলাররা সেখান থেকে বের হতে না পারে। আগে থেকে নিশ্চয়ই এ রকম একটা প্ল্যান করা ছিল। সুতরাং সেখানে একটা ক্লাশ-ট্যাশ হয়। তখন যা সাধারণত হয়ে থাকেÑ আটকা পড়া জেলাররা বাঁশি বাজিয়ে দিল। বাঁশিতে ফুঁ দিলে সিগন্যাল হয়ে যায়। পাগলা ঘণ্টি বাজতে আরম্ভ করে। আর্মড সিপাহীরা খাপড়া জেলের দিকে ছুটে আসে। জেলাররা তখনো ভিতরে আটকা পড়ে আছে। পলিটিক্যাল প্রিজনাররা খাট-টাট এসব জানালার সামনে রেখে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিপাহীরা এসে জানালায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করতে শুরু করে। সাতজন পলিটিক্যাল প্রিজনার নিহত হয়। আহত হয় অনেকে” (‘আমি সরদার বলছি’, অন্বেষা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৩)।
এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের কামরায় বন্ধ করে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়। যে কয়েকজন বেঁচেছিল, তাদের এমনভাবে মারপিট করা হয়েছিল যেÑ জীবনের তরে তাদের স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন জেলে অত্যাচার চলেছিল, রাজনৈতিক বন্দিরাও তাদের দাবি আদায়ের জন্য কারাগার থেকেই অনশন ধর্মঘট করছিল। রাজনৈতিক বন্দিদের অনেক পরিবারের ভিক্ষা করেও সংসার চালাতে হয়েছে। নিয়তিই বলতে হবে! কারণ যারা ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আন্দামানের যাবজ্জীবন কারাদ- ভোগ করেছেন, তাদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়া পরে স্বাধীন দেশের জেলে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। লিয়াকত আলী খান তার কথা রাখবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল করবে, তাদের ‘শের কুচলে দেঙ্গে’Ñ কথা ঠিকই রেখেছিলেন। মাথা ভাঙতে না পারলেও মাজা ভেঙে দিয়েছিলেন জেলে রেখে ও নির্যাতন করে” (প্রাগুক্ত, ১৭২)।
রাজশাহী কারাগার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে খুলনা ও অন্যান্য জেলে আলাপ হওয়ার পর শেখ মুজিবের মনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, এরই প্রকাশ ঘটেছে ওপরের এসব লাইনে।
‘অসামাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বসেই লেখেন। কারাসাহিত্য হিসেবে সেগুলোর অনন্য মূল্য রয়েছে। পরে এ প্রসঙ্গ ধরে আমরা নিশ্চয়ই আলোচনা করব।
(চলবে)
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক