advertisement
advertisement
advertisement.

বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার স্মৃতিতে শহীদ শেখ কামাল

ড. মিল্টন বিশ্বাস
৫ আগস্ট ২০২০ ১২:০০ এএম | আপডেট: ৫ আগস্ট ২০২০ ০৮:৪১ এএম
advertisement..

৫ আগস্ট শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান শেখ কামাল ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই গোপালগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু এবং একদিনের কারাবরণ করেন। ঢাকায় সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদানের জন্য পুনরায় তিনি একই বছর ৩১ ডিসেম্বর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বন্দি থাকেন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ শেখ কামালের জন্মের সময় তিনি মুক্ত ছিলেন।

তবে ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে শামিল হয়ে ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত ৭১ দিন কারাগারে থাকেন। অবশ্য এর আগে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। অর্থাৎ শেখ কামালের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা শহরের বাসিন্দা।

advertisement

কামাল সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। তিনি লিখেছেন, ‘মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভালো করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাসিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলেমেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সব কষ্ট সহ্য করে। কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে উঠে এসেছে শিশু শেখ কামালের একটি অসাধারণ ঘটনাÑ যা একদিকে মর্মন্তুদ ও রাজনীতিবিদদের পারিবারিক জীবনের জন্য বেদনাদায়ক। অংশটি এ রকমÑ “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাসু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাসু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাসিনাকে বলছে, ‘হাসুু আপা, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’

কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই, তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনাবিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ, তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেই বা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে।”

‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনা এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেপ্তার হন। আমি তখন খুব ছোট আর আমার ছোট ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সেই সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে।

গোপালগঞ্জ থানায় একটি বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খেলার মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে, আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না। আজ ও নেই। আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই।

ঘাতকের বুলেট শুধু আব্বাকেই ছিনিয়ে নেয়নি, আমার মা, কামাল, জামাল, ছোট্ট রাসেলও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি কামাল-জামালের নবপরিণীতা সুলতানা ও রোজী, যাদের হাতে মেহেদির রঙ বুকের রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে।... সেদিন কামাল আব্বাকে ডাকার অনুমতি চেয়েছিল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই আব্বাকে ওর কথা বলি। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন।’

১৯৬৬ সালে শেখ কামালের বয়স ১৭ বছর। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৯ মে গ্রেপ্তার হয়ে একটানা দীর্ঘদিন কারাগারে আটক ছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্ত হন। বন্দি হওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বেগম মুজিব দেখা করার জন্য সন্তানদের নিয়ে উপস্থিত হতেন।

কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করে উত্তীর্ণ হন। বঙ্গবন্ধু নিজের পুত্র সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দেশরক্ষা আইনে বিচার হয়েছে। এই একই ধরনের বক্তৃতার জন্য ডজনখানেক মামলা দায়ের করা হতেছে। মামলার কিছুই নাই, আমাকে জেল দিতে পারে না। যদি নিচের দিকে জেল দিতে বাধ্য হয়, তবে জজকোর্ট ও হাইকোর্টে টিকবে না। সহকর্মী অনেকে এসেছিল, দেখা হলো। কামাল এসেছিল। বলল, পরীক্ষা ভালো দিয়েছে। আব্বা খুলনায় আমার ভাইয়ের বাসায় চিকিৎসাধীনে আছেন। একটু ভালোর দিকে। এখনো আরোগ্য লাভ করেন নাই। মাও সাথে আছেন।’

উল্লেখ্য, শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

শেখ কামাল ছিলেন উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত ও পরোপকারী ব্যক্তিত্বের পুরোধা। ৩০ বছর (১৯৪৯-১৯৭৫) পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি এ দেশের মানুষের কাছে আদর্শের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যারা তার সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তারা অনুভব করেছেন তার ¯িœগ্ধ ও হাস্যোজ্জ্বল মমত্ববোধ। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এ প্রাণোচ্ছল শেখ কামালের পরিচয়ই স্মৃতিতে অমর করে রেখেছেন।

 

ড. মিল্টন বিশ্বাস :  বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়