advertisement
advertisement
advertisement

বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে

নিশাত সুলতানা
১৬ মার্চ ২০২১ ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২১ ১১:৩৪ পিএম
advertisement

কিছুদিন আগে সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হঠাৎ একটি দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। ঢাকার একটি ব্যস্ত এলাকা সংলগ্ন গলিতে লক্ষ করলাম বর্জ্য ফেলার জায়গাটির খুব কাছে একজন পথচারী প্রাকৃতিক কাজ সারছেন। খুবই অস্বস্তিকর এই দৃশ্যটি ঢাকা শহরে মোটেই বিরল নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না। কারণ, যে স্থানে বসে ব্যক্তিটি প্রাকৃতিক কর্ম সারছিলেন তার খুব কাছে দেয়ালে লাগানো ছিল একটি ছাত্র সংগঠনের পোস্টার। সেই পোস্টারে ছাত্রনেতাদের ছবির সঙ্গে লক্ষ করলাম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। পোস্টারটির উচ্চতা আরেকটু নিচে হলে কী হতে পারত, তা ভাবতেই অসহায় লাগছিল। এর ঠিক দুদিন পর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে রাস্তার দুধারে লক্ষ করেছি অসংখ্য নির্বাচনী পোস্টার। এসব পোস্টারে ছিল ছোট-বড় অসংখ্য নেতানেত্রীর মুখ। সেসব মুখের ভিড়ে পোস্টারের কোনো এক প্রান্তে লক্ষ করেছি বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি। অনেক পোস্টারের ক্ষেত্রেই কিছু নেতা নিজেদের মহিমান্বিত করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, তাদের রঙিন ডিজিটাল ছবির ঝলকে ম্লান হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর সাদাকালো ছবি। জাতির পিতা তো বটেই প্রধানমন্ত্রীর ছবিরও এই ধরনের ব্যবহারে অস্বস্তিবোধ করেছি। এসব পোস্টারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা চেষ্টা করেছেন, স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সব নেতানেত্রীকে সন্তুষ্ট করতে। বোধ করি, আমার মতো অনেকেই যত্রতত্র এই ধরনের পোস্টারে, ব্যানারে এবং অন্যান্য উপকরণে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর অবমাননাকর ছবির ব্যবহারে বিব্রতবোধ করেন।

advertisement

ইদানীং পথে-ঘাটে, কারণে-অকারণে নেতা-নেত্রীদের ছবি সংবলিত পোস্টার ব্যবহারের এই বিষয়টি রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এসব পোস্টারে না আছে শুদ্ধ বানানের ব্যবহার আর না আছে ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নান্দনিকতা কিংবা মূল্যবোধের প্রতিফলন। যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবি; যেন তার ছবি ব্যবহার করলেই বৈধতার লাইসেন্স পেয়ে যায় সবকিছু। পোস্টার-ব্যানার লাগানোর উদ্দেশ্যটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এসব সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না কেউ। ফলে এসব ছিঁড়ে কিংবা নষ্ট হয়ে এক সময় হাওয়ায় ওড়ে, নর্দমায় মেশে কিংবা পানিতে ভাসে। সেই সঙ্গে উড়তে থাকে কিংবা পানিতে ভাসতে থাকে বাঙালি আবেগ আর ভালোবাসার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। বাসের গায়ে যাত্রীর বমিতে মাখামাখি হয়ে কিংবা ডাস্টবিনসংলগ্ন দেয়ালে চরম অনাদরে বিকৃতভাবে দৃশ্যমান হয় মহান এই নেতার ছবি। এমন দৃশ্যও বিরল নয়, যেখানে ছবি থেকে খুবলে তুলে ফেলা হয়েছে তার চোখ কিংবা দেয়ালে সাঁটা ছবিতে কলমের আঁচড়ে কেউ বা বিকৃতভাবে এঁকে দিয়েছে দাড়ি কিংবা গোঁফ। এসব তার মর্যাদার প্রতি চরম অবমাননারই উদাহরণ।

সংবিধানের ৪-এর ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সব সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশায়িত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোয় সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’ কিন্তু এই নির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারসংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কারণ বিষয়টি শুধু অফিস-আদালতে তার ছবি ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই পোস্টারে, ব্যানারে, ফেস্টুনে, যোগাযোগ উপকরণে, বইয়ের মলাটে তার কোন ছবিগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। আবার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-র দিকে তাকাই, তা হলে সেখানে ২১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এই ধরনের অপরাধ সংঘটনের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- এবং অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই আইনটিতেও যত্রতত্র যেনতেনভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগে আনা যাবে কিনা সে সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করে না। ফলে বিভ্রান্তি থেকে যায়।

advertisement

যত্রতত্র বঙ্গবন্ধুর ছবি ও প্রতিকৃতি ব্যবহারের এই বিষয়টি অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত। আর যদি ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে থাকা উচিত সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। বঙ্গবন্ধুর ছবির ডানে, বামে, নিচে কে বা কারা থাকবেন সে সম্পর্কেও পরিষ্কার নির্দেশনা প্রয়োজন। আমরা জানি মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ব্যবহার সংক্রান্ত একটি লোগো উন্নয়ন করা হয়। শুধু তাই নয়, লোগো যথোপযুক্তভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। এই ধরনের উদ্যোগ স্থায়ীভাবে নেওয়া যেতে পারে। এই নির্দেশনা দলীয় আয়োজনসংক্রান্ত পোস্টার, প্রকাশনা, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা, ব্যানার, অন্যান্য যোগাযোগ উপকরণ উন্নয়ন কিংবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেনে চলাকে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে শুধু দলীয় সদস্যরাই শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে না, উপকৃত হবে সারাদেশের মানুষ। এই নির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর মর্যাদাপূর্ণ উপস্থাপনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শুধু বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেই নয়, প্রধানমন্ত্রীর ছবিও কোথায় কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেই সম্পর্কে থাকা প্রয়োজন সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

মনে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির কাছে এক আবেগ আর অনুভূতির নাম। তিনি বাঙালির মুক্তির দিশারি মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আর প্রধানমন্ত্রী হলেন একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাই তাদের ছবির অবমাননাকর ব্যবহার অচিরেই বন্ধ হোক।

নিশাত সুলতানা : লেখক ও উন্নয়নকর্মী