নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে কিছুদিন আগে আবারও ঘটেছে ধর্ষণের ঘটনা। মনে পড়ে ঘটনার পরদিন সকালে সংবাদপত্র হাতে নিতেই সংবাদটির শিরোনামে চোখ আটকে যায়। বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক স্কুলছাত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং মুঠোফোনে তা ধারণ করা হয়েছে। অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকায় বিস্তারিত পড়তে পারিনি সেদিন। ধর্ষণের সংবাদ মনের ওপর এতটাই চাপ তৈরি করে যে, এই ধরনের সংবাদ পড়া থেকে অনেক সময়ই নিজেকে বিরত রাখি স্বার্থপরের মতো। তবে এভাবে তো আর সত্যকে এড়ানো যায় না। প্রতিবছর হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনাই আমাদের বাস্তবতা। ধর্ষণের জনপদ হয়ে ওঠা বেগমগঞ্জের এই সংবাদটির বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলেও অনেক কাজের ভিড়ে ঘটনাটি মন থেকে হারিয়ে যায়। কয়েকদিন পর আরেকটি ধর্ষণের খবরে মনে পড়ে যায় বেগমগঞ্জের ঘটনাটি। ততদিনে বেগমগঞ্জের ঘটনার সংবাদ প্রকাশের তারিখটি ভুলে গেছি। উপায়ন্ত না দেখে গুগলে ’ধর্ষণ’, ’আগস্ট’ আর ’২০২১’ লিখে সার্চ দিই। মুহূর্তেই সংবাদপত্রের যে লিংকগুলো বেরিয়ে আসে তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যাই। আগস্ট মাসের একটি দিনও সম্ভবত ধর্ষণমুক্ত ছিল না। ধর্ষণের শিকার হয়েছে আট বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশকেন্দ্রের হিসাব অনুসারে গত তিন বছরে নারীর প্রতি অন্য যে কোনো সহিংসতার মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ধর্ষণ। তাদের পরিসংখ্যান বলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বলে ক্রমবর্ধমান এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। মনে রাখতে হবে এর বাইরেও ধর্ষণের অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত রয়ে যায় সামাজিক কলঙ্ক আর আপস-মীমাংসার প্রবল চাপের মুখে। ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে অভিযুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকেন সমাজের অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর এমনকি প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি পর্যন্ত। গত বছর অক্টোবরে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় যে ক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তারই পথ ধরে সরকার ১৩ অক্টোবর ২০২০ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনে। এতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান করা হয়। বিশ্লেষকরা তখনই আশঙ্কা করেছিলেন আইনের এই সংশোধন ধর্ষণের প্রতিকারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। তাদের সেই আশঙ্কাই অবশেষে সত্য হয়েছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে সীমাবদ্ধতা সেখানে আইনের সংশোধন অবস্থার পরিবর্তনে তেমন কোনো প্রভাব রাখবে না এটাই স্বাভাবিক। আইন প্রয়োগের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে শুধু আইন সংশোধন করে তেমন কোনো লাভ হবে না।
প্রথম আলো ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ বছরে ঢাকা নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আসা মামলার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা যায়, সেই ১৫ বছরে ধর্ষণের তিনটি ধারায় মোট ৫ হাজার ৫০২টি মামলার মধ্যে নিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা মাত্র ২৮৯৮টি। এসব নিষ্পন্ন মামলায় সাজা পেয়েছে মাত্র ৮৭ জন। সাজার মধ্যে আছে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ-, বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধে করা মামলার ক্ষেত্রে সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ ধর্ষণ মামলায় কোনো সাজা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব, উপযুক্ত প্রমাণের অভাব, আলামত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত জ্ঞানের অভাব, প্রভাবশালীদের চাপ, লোকলজ্জা ও সামাজিক দোষারোপ, নারীবান্ধব আইনজীবীর অভাব ইত্যাদি নানা কারণে ধর্ষণের মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- করা হলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং কোভিডকালীন আরও বেড়ে গেছে নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের ঘটনা। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। আইনের কার্যকারীতা প্রমাণিত না হলে শুধু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। অপরাধীর কঠোরতম সাজার বিষয়টি আইন দ্বারা নির্ধারিত হলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে ভুক্তভোগীরা কখনই আইনের সুফল লাভ করবে না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আইন পরিবর্তনের বিষয়টি যে গণআন্দোলনকে আপাত ঠেকানোর একটি কৌশল তা বুঝতে আর বাকি থাকবে না। তাই প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও অপরাধীর উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করা।
আইন ও সালিশকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে চারজনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হচ্ছেন, প্রতিদিন তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ যে কী ভীষণ লজ্জার আর অপমানের! নারীরা কোনো অপরাধে প্রতিদিন এই ধরনের পৈশাচিকতার শিকার হচ্ছেন তার জবাবদিহিতার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারের। আইন প্রণয়ন, তার সংশোধন ও যুগোপযোগী করার পরও নারীরা যদি অরক্ষিত থাকেন, তবে অবশ্যই আইন প্রয়োগের ব্যর্থতার দায়ভার তাদের নিতে হবে। কোনো ধর্ষণের জনপদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন হয়নি এই দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকার অর্থ হলো দেশের উন্নয়নের গতি অর্ধেক হয়ে যাওয়া। তাই আমরা শুধু আইন চাই না, চাই আইনের সঠিক ও সর্বোচ্চ প্রয়োগ। বস্তুতপক্ষে প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে মোড়কে আবদ্ধ আইনের সঙ্গে ড্রয়িংরুমের সাজানো শোপিসের তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। শুধু সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশনের জন্য আইনের সৃষ্টি হয়নি। বরং যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকের নিরাপদ ও সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার মধ্যেই নিহিত থাকে আইনের সার্থকতা।
নিশাত সুলতানা : লেখক ও উন্নয়নকর্মী