নরসিংদী কলেজে বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সে সময় বাজল মুক্তিযুদ্ধের দামামা। কলেজ বন্ধ হলো, পালাতে লাগল মানুষ। তিন দিন যাবৎ বিভিন্ন নৌকায় চড়ে পৌঁছালাম আমার গ্রামে, সুনামগঞ্জে। মাসতিনেক পর এক ভোরবেলায় গুলির শব্দে ঘুম ভাঙল। বাড়ির বাইরে এসে দেখি নদীতে নৌসেনার এক বিশাল জাহাজ, সঙ্গে পাঁচ-ছয়টা স্পিডবোট। ওরা গুলি করছিল গ্রামের বাড়িঘরের দিকে তাক করে। বজ্রপাতের মতো সব কাঁপিয়ে আছড়ে পড়ছিল মর্টারের গোলা।
অন্যদের চিৎকারে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। ছুটে বাড়িতে ঢুকে চোখের সামনে যা পেলাম নিয়ে আমরা দৌড়ে ঢুকে পড়লাম পাশের জঙ্গলে। রাত পর্যন্ত লুকিয়ে রইলাম সেখানেই। শুনলাম সেই জাহাজ নদীতীরে রাখা হয়েছে, আর আমাদের গ্রামে তৈরি করা হয়েছে সেনানিবাস। স্থানীয় কয়েকজন মানুষকে ধরে নিয়ে এসেছিল হানাদাররা। তাদের মধ্যে একজন আমার খুবই কাছের বন্ধু। ধারণা করেছিল এরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে।
বাবা বললেন, সীমান্ত পার করে মেঘালয়ের শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে আগানো উচিত আমাদের। কিন্তু তিনি নিজে যেতে পারবেন না, প্যারালাইজ্ড। মাসির সঙ্গে থেকে যাবেন। পরদিন আমরা শরণার্থীদের লম্বা লাইনে যোগ দিলাম। এক জায়গায় এত মানুষ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। সব বয়সের, সব ধরনের মানুষ, নিজেদের পুরো জীবন একটা বা দুটো ব্যাগে পুরে হাঁটছে, অচেনা দেশের দিকে, অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে। সীমান্ত পার হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মেঘালয়ের সেই ক্যাম্পে কলেরা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ওষুধ ও রিলিফ বিতরণ আর তাদের খাবার তৈরিতে সাহায্য করতাম আমি। এই সময়টাতেই উন্নয়ন কর্মের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর সেই বহু আকাক্সিক্ষত খবর পেলাম। যুদ্ধের সমাপ্তি। আমরা স্বাধীন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নিজেদের বাড়ি ফিরলাম আমরা। বিধ্বস্ত, শূন্য, প্রায় অচেনা এক সুনামগঞ্জ। বাবা বাড়িতেই ছিলেন। আমি মা আর বোনকে বাড়িতে রেখে অন্য শরণার্থীদের খোঁজ নিতে বের হলাম। রাস্তায় আমার এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা, নাম আব্দুল মতিন। আমাকে দেখে স্যার বললেন, ‘ঢাকা থেকে কয়েকজন মানুষ এসেছে। তোমার জন্য কিছু কাজ থাকতে পারে তাদের কাছে।’ গেলাম মতিন স্যারের পিছে পিছে। তিনি আমাকে স্থানীয় সরকারি গেস্ট হাউসে নিয়ে চারজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা পুনর্নির্মাণের কাজে এসেছিলেন। দলনেতা ছিলেন ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী নামে একজন। আমাকে তাদের গাইড হতে বলতেই রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন এলাকার বিভিন্ন জায়গা চিনিয়ে দিলাম।
শাল্লা নামক ছোট্ট এক জেলে গ্রামে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। জেলেদের জন্য শুধু রিলিফ পণ্যের আয়োজন না করে আমরা তাদের জন্য নৌকা আর মাছ ধরার জালের ব্যবস্থা করলাম।
কাজ করতে পারবে এমন কতজন নারী-পুরুষ আছেন, কতগুলো জাল আর নৌকা লাগবে- এগুলো আমরা প্রথমে জরিপ করে জেনে নিই। এই জরিপ ব্র্যাকের ইতিহাসের সর্বপ্রথম কাজগুলোর একটা। দুদিন পর, জরিপ শেষে পুনর্নির্মাণ কাজের দায়িত্ব আমাদের ওপর দিয়ে ভিকারুল সাহেব ঢাকায় চলে গেলেন। বলে গেলেন আমরা যেন একটা অফিস নিয়ে রাখি। আরও বলেছিলেন, ‘ফজলে হাসান আবেদ নামে একজন এখানে আসবেন। তিনিই আপনাদের জানাবেন এর পর কী করা দরকার।’ ফেব্রæয়ারি মাসেই আমরা এক ঘরের একটা ছোট্ট অফিস তৈরি করি। নিজেদের নাম দিয়েছিলাম ‘ত্রাণ সংঘ’। কাপড়ের ব্যানারে নাম লিখে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম অফিসের বাইরে। মার্চের এক সকালে দেখি অফিসের বাইরে একজন মানুষ, পরিপাটি পোশাক পরা। চোখে কৌত‚হল নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের ব্যানারের দিকে। তিনিই ফজলে হাসান আবেদ। বিকালে আমরা যা করেছি আর যা করতে হবে- এসব আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো সংস্থার নাম বদলানো হবে। নতুন নাম হবে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি। আর সেভাবেই, শাল্লা নামের ছোট্ট গ্রামে ব্র্যাকের জন্ম। সেই হিসেবে আমিই হয়তো প্রথম ব্র্র্যাককর্মী।
৪০ বছর ব্র্যাকের সঙ্গে অসংখ্য কাজ করেছি। দেশ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন গ্রামের উন্নয়ন- তাই কৃষি, মাছের চাষ, বয়স্ক শিক্ষা এমন বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। গবেষণা এবং যাচাই বিভাগ সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছি। আমার ধারণা ফজলে হাসান আবেদকে আবেদ ভাই ডাকার যে রীতি, তা আমি শুরু করেছিলাম। ব্র্যাকের যাত্রার প্রথমদিকে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার ডাকব কিনা। তিনি বলেছিলেন, যা ডাকতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাই ডাকতে পারি। ‘আপনাকে আমি আবেদ ভাই বলে ডাকব’, বলেছিলাম। ‘ঠিক আছে’, ছিল তার জবাব। সেই থেকে শুরু। পরে সহকর্মীদের ভাই এবং আপা ডাকা ব্র্যাকের রীতিতে পরিণত হয়।
যদি জীবন থেকে কোনো শিক্ষা পেয়ে থাকি, তা হলো এই : আশার মৃত্যু নেই। অন্ধকার সময়গুলোতেও কোথাও আশার আলো লুকিয়ে থাকে। খুঁজলে সেই আলোর পথ পাওয়া সম্ভব। যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি, তা হলে পথ খুঁজে পাওয়া সহজ। ৫০ বছর পর, আমার অবসরের ১১ বছর বাদে, আজও ব্র্যাক নিঃসন্দেহে আমার পরিবার, আমি ব্র্যাকের সদস্য।
গীষ্পতি রায় : ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মী