advertisement
advertisement
advertisement.

নায়ক থেকে খলনায়ক

জাহাঙ্গীর সুর
১৪ মে ২০২২ ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৪ মে ২০২২ ১১:৪০ এএম
advertisement..

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলংকা সবচেয়ে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। সরকার চলমান করোনা ভাইরাস মহামারীতে পর্যটন খাতের ‘অপ্রত্যাশিত মৃত্যু’কে দায়ী করছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলো এবং সাধারণ জনতা সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে আসছে। এ জন্য যুদ্ধজয়ী নেতারা এখন সাধারণের চোখে খলনায়ক। বিবিসির বিশেষ প্রতিবেদনটির নির্বাচিত অংশের অনুবাদ করেছেন জাহাঙ্গীর সুর আনবারাসন এথিরাজন এপ্রিলের শুরু থেকে বিক্ষোভের শুরু। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার প্রধানমন্ত্রী, বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে সোচ্চার সাধারণ জনতা। অভিযোগ, তারা শ্রীলংকার অর্থনীতিকে ধ্বংসের খাদে ফেলে দিয়েছেন। বিক্ষোভ চলতি সপ্তাহে আরও জোরালো হয়ে ওঠে।

মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকেরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করার পর তিনি পদত্যাগ করেছেন। ওই হামলার পর দেশজুড়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। রাজাপাকসে পরিবারসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।

advertisement

৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দাকে তার সরকারি বাসভবনে বিক্ষোভকারীরা অবরুদ্ধ করে ফেললে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। নিরাপত্তার জন্য দেশের উত্তর-পূর্বের একটি নৌঘাঁটিতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। দেশটির একটি আদালত তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন, দুবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের জন্য যা একেবারেই অপমানকর।

মাহিন্দার বিদায়ও তার কোণঠাসা ছোট ভাই গোতাবায়ার (যার বয়স ৭২ বছর) ওপর চাপ কমাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত তিনি পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করে যাচ্ছেন। অবশ্য এরই মধ্যে তাকে কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। যেমন, নিজের কিছু নির্বাহী ক্ষমতা তিনি সংসদকে দিতে সম্মত হয়েছেন। প্রবীণ রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন, যিনি এখন একটি জাতীয় সরকার গঠনে কাজ করবেন।

তবে গোতাবায়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো সুতায় ঝুলছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তার গদিচ্যুত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলংকা তার ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। ফলে আরও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা দেশটির নেই বললেই চলে। যে পরিবারটি এক দশকেরও বেশি সময় শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল, সেই পরিবারের জন্য এটি এক নাটকীয় পতন।

শ্রীলংকার তিন দশকের গৃহযুদ্ধ অবসানের বীরত্বস্বরূপ বেশিরভাগ সিংহলির কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে এক সময় নায়ক ছিলেন, যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে কঠোরভাবে তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। যুদ্ধের পর বিজয় কুচকাওয়াজ ও বিশাল সমাবেশে তাকে সিংহল বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুসাল পেরেরা যেমনটা বলেছেন, ‘শ্রীলংকার স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে মাহিন্দা ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহল বৌদ্ধ নেতা। এমনকি কেউ কেউ তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করত।’

দ্বীপ রাষ্ট্রটির রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিকা এবং কীভাবে মাহিন্দা ক্ষমতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন, পেরেরা ২০১৭ সালে তার বই ‘রাজাপাকসে : দ্য সিংহালা সেলফি’তে তা আলোচনা করেছেন।

মাহিন্দার বাবা ছিলেন আইনপ্রণেতা। মাহিন্দা ধীরে ধীরে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা থেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। এক বছর পর যখন মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হন, তখন তিনি ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন তিনি। এ পদে নিয়োগ ছিল তার পেশাগত জীবনের জন্য বড় অর্জন।

ভাইয়ের প্রচারাভিযানে যোগ দিতে দেশে ফিরে আসেন গোতাবায়া। দিনে দিনে হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ। বেপরোয়া আচরণের জন্য সমালোচিত হন। এর পর তার অন্য ভাই ও আত্মীয়রা সরকারে যোগ দেন। মাহিন্দা ছিলেন পরিবারের প্রধান। রাজাপাকসে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনের মূল ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

এত দিন পর্যন্ত সব সময় এক শক্তি হিসেবেই ছিলেন রাজাপাকসেরা। তবে সম্প্রতি সব পাল্টে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে গোতাবায়া যখন মাহিন্দাকে ‘বাকি সবার স্বার্থে একজনকে বলি’ হওয়ার অপ্রিয় সিদ্ধান্তটি নিতে বলেন এবং বিক্ষোভকারীদের দাবিতে সাড়া দিয়ে পদত্যাগ করতে বলেন। যে ছোট ভাইকে নিজে এনেছিলেন সরকারে, তার এমন দাবি মেনে নিতে মাহিন্দার মনোকষ্ট অস্বাভাবিক নয়। তিনি নিশ্চয়ই নিজের রাজনৈতিক জীবনের যবনিকা এভাবে টানতে চাননি।

পেরেরা বলেন, ‘মূলত তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তরুণদের জোরালো বিক্ষোভের মুখে তিনি সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বয়সের কারণে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না।’

অবশ্য রাজাপাকসে ভাইদের মধ্যে কোনো ধরনের টানাপড়েনের কথা অস্বীকার করেছেন মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল। তবে চলতি সপ্তাহে পদত্যাগের আগে তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘অবশ্য প্রেসিডেন্ট এবং [সাবেক] প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নীতিগত মতপার্থক্য তো রয়েছেই।’

নামাল বলেন, তার বাবা সব সময় কৃষক ও গণমানুষের সঙ্গে ছিলেন। অন্যদিকে গোতাবায়া রাজাপাকসের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ‘গণমানুষ কিংবা ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা পোদুজানা পেরামুনার মূল ভোটব্যাংকের চেয়ে ভাসমান ভোটে বেশি নজর তার।’

মাহিন্দার পদত্যাগে বিক্ষোভকারীরা হয়তো খুশি। তবে গোতাবায়াকেও গদি ছাড়তে হবে, এ দাবিতে অনড় তারা। যদিও গোতাবায়ার সমর্থকরা বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন। সাবেক গণমাধ্যমমন্ত্রী নাকালা গোদাহেওয়া বিবিসিকে বলেছেন, ‘যেহেতু বাইরে অরাজক অবস্থা এবং এ জন্য যৌক্তিক কারণও আছে- তা মানছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, গোতাবায়াকে পদত্যাগ করতে হবে।’

ভোটারদের সমর্থন হারানো প্রেসিডেন্ট এখন কী করবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ভোটাররাই ২০১৯ সাল থেকে বিপুল ভোটে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা নেই বলে ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়ে রেখেছেন গোতাবায়া। তবে তিনি বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারে দেশকে নেতৃত্ব দিতে চান।

শ্রীলংকার সর্বত্র রাজাপাকসেবিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং দেশ পরিচলানার ইচ্ছাপূরণে তার হাতে বিকল্প কী? বেপরোয়া আচরণের জন্য আগে থেকেই বদনাম আছে। কোণঠাসা হয়ে পড়লে ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রেসিডেন্ট যে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন, সেই শঙ্কাও তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

রাজাপাকসে পরিবার এক সময় সিংহল জনগোষ্ঠীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। যদিও তাদের বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আগে মুখ খোলেনি। কিন্তু এখন গোটা দেশ আক্রান্ত। বেঁচে থাকার লড়াই যেন রাজপথে ঐক্যবদ্ধ করেছে সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে। এমনকি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়েও সোচ্চার সিংহলি বিক্ষোভকারীরা।

মানবাধিকার আইনজীবী ভবানি ফনসেকা যেমনটা বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক দুর্দশা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কেও আঘাত করেছে। আকস্মিকভাবে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা মনে হয়, কয়েক দশক ধরে যে রাজাপাকসে পরিবার এত অন্যায় করেও পার পেয়ে গেছেন, এখন এত গণক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখে তারাও বিস্মিত।’

রাজাপাকসে পরিবার এত সহজে তাদের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। কারণ, তারা শুধু নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত নন, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও তারা শঙ্কিত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে নিযুক্ত হয়তো এ কারণেই করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, রাজাপাকসে পরিবারের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক আছে।

অবশ্য শ্রীলংকার অনেক মানুষই প্রেসিডেন্টের এমন কৌশলে হতাশ। ধৈর্যও হারাচ্ছেন তারা। স্থিতিশীল সরকার ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে ঋণের জন্য দরকষাকষি কিংবা ঋণ পুনর্গঠন সহজ হবে না। পরবর্তী সরকার কাজটি দ্রুত করতে না পারলে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে। জ্বালানি সংকটও বড় হবে।

কলম্বোর বাসিন্দা চাঁদনি মানেল বলেছেন, ‘ক্ষমতায় কে এলো কে গেল, সেটা দেখে কী করব। আমরা চাই আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হোক।’