আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। দিবসটির এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, সুস্থ থাকুন দীর্ঘদিন।’ বিশ্বব্যাপী ১২০ কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার পেছনে উচ্চ রক্তচাপ অনেকাংশে দায়ী। এটি একটি নীরব ঘাতক।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ : ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা। হরমোনঘটিত কিছু রোগ ব্যাধি, কিডনির রোগ, স্টেরয়েড জাতীয় এবং অন্য কিছু ওষুধ ৫-১০ শতাংশ রক্তচাপের জন্য দায়ী। এছাড়া গর্ভকালীন অবস্থায় সাময়িক সময়ের জন্য কেউ কেউ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে পারে। তবে অনেকগুলো উপাদান উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বয়স, স্থূলতা, অতিরিক্ত চর্বি ও লবণ জাতীয় খাবার গ্রহণ, বংশগত ধারা, আরামপ্রদ যাপিতজীবন, অতিরিক্ত মানসিক অভিঘাত উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি।
লক্ষণ ও ক্ষতিকর প্রভাব : সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কখনো কখনো উচ্চ রক্তচাপের কারণে মাথাব্যথা, নাক থেকে রক্তক্ষরণ, ঝাপসা দৃষ্টি, বুক ধড়ফড়ং ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে বমি, বুকব্যথা, অস্থিরতা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এটি নীরবে নিভৃতে রক্তনালি এবং হৃৎপি-ের ক্ষতি সাধন করে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। হার্ট ফেইলিউরের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে রক্তচাপ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ চোখের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্তর রেটিনার ক্ষতিসাধন করে। ফলে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসে। কিডনি ফেইলিউরের পেছনে উচ্চ রক্তচাপ অনেকাংশে দায়ী। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপ হলো এক ধরনের নীরব ঘাতক।
রক্তচাপ নির্ণয় : হৃৎপি- যখন সংকুচিত হয়, তখন রক্তনালিতে যে চাপ অনুভূত হয়, তা হচ্ছে সিস্টোলিক রক্তচাপ। আর হৃৎপি- যখন প্রসারিত হয়, তখন রক্তনালিতে চাপ কমে আসে। সেটি হচ্ছে ডায়াস্টলিক রক্তচাপ। সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ যথাক্রমে ১৪০ ও ৯০ মি.মি পারদের বেশি হলে তাকে বলা হয় উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপ নির্ণয় করা অত্যন্ত সহজ। এ জন্য হাসপাতাল বা ল্যাবরেটরিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ঘরে বসেই রক্তচাপ মাপক যন্ত্রের সাহায্যে যে কেউ এটি নির্ণয় করতে পারেন। তবে অনেকেই সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপ করতে পারেন না। সেই জন্য অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে এটি নির্ণয়ের পদ্ধতি জেনে নেওয়া অত্যন্ত উত্তম।
সাময়িক রক্তচাপ বৃদ্ধি : কখনো সাময়িক সময়ের জন্য রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। পরিমাপ করে একবার রক্তচাপ বেশি পেলেই উচ্চ রক্তচাপ বলা যৌক্তিক হবে না। বিশেষত অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সামনে এলে কারও কারও মানসিক উদ্বিগ্নতার কারণে রক্তচাপ সাময়িকভাবে স্বল্পমাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। এর নাম হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন। এমনটি হওয়া বিচিত্র নয়। তাই একবার ডাক্তারের চেম্বারে এসে রক্তচাপ বেশি পেলেই তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া ঠিক নয়। রক্তচাপ একাধিকবার মেপে যদি এটি সার্বক্ষণিক বেশি পাওয়া যায়, তবেই ওষুধ শুরু করতে হবে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে করণীয় : রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ কিছু নিয়মাবলি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। যাপিতজীবনে আনতে হবে পরিবর্তন। লবণ গ্রহণ সীমিত করতে হবে। দৈনন্দিন লবণ গ্রহণের পরিমাণ হবে দেড় গ্রাম। চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণে সচেতন হতে হবে। তবে মাছের চর্বি উচ্চ রক্তচাপের জন্য উত্তম। শরীরের অতিরিক্ত ওজন বিদায় করতে হবে। খাদ্যতালিকায় স্থান দিতে হবে শাকসবজি, বাদাম, ফলমূল ইত্যাদি। নিয়মিত শরীরচর্চার ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ১৫০ মিনিট জোর কদমে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। মানসিক অভিঘাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রার্থনা, মেডিটেশন, ইয়োগা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বাইরে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি করা যেতে পারে। ঘুমাতে হবে প্রতিদিন অন্তত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। এসবের পাশাপাশি অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ শুরু করতে হবে। যে কোনো প্রকারে রক্তচাপ অবশ্যই সীমানার মধ্যে রাখতে হবে। নয়তো বিপদ।
লেখক : মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, সিএমএইচ, ঢাকা
চেম্বার : আল রাজি হাসপাতাল
(দ্বিতীয়তলা) ফার্মগেট, ঢাকা
০১৭৫৬১৭৩৭৬৫, ০১৭২৬০৫০৯১২