করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পাশাপাশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বিশ্বঅর্থনীতি। চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতিও। এই চাপ সরকারি খাতে যেমন আছে, রেহাই পায়নি বেসরকারি খাতও। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যেই নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে আমানতের প্রবাহ। দুই বছর ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত থাকায় ব্যাংকে কমেছে তারল্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় অনেক ব্যাংক সংকট কাটিয়েছে, তবে কিছু ব্যাংক এখনো তারল্য সংকটে ভুগছে।
বিনিয়োগ কমায় কর্মসংস্থানের গতিও মন্থর। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। সেই তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। কিন্তু রেমিট্যান্স কমায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। আবার মহামারীর কারণে যেসব এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি স্থগিত ছিল, সেগুলোও এখন দিতে হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে কমতে শুরু করে। বর্তমানে যে মজুদ আছে, তা দিয়ে ৪ থেকে ৫ মাসের বেশি আমদানি-ব্যয় মেটানো যাবে না। বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকলে রিজার্ভে বড় ধরনের টান পড়বে। অন্যদিকে বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার ছাড়ার সক্ষমতা থাকছে না। ফলে টাকার পতনের ধারা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে টাকা ও ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
সরকার ৬ দশমিক ২২ শতাংশের যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে, তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতির কথা ছয় শতাংশের ওপরে বলে থাকে, যেটি প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে আদৌ মেলে না। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। যেমন- ভোজ্যতেল ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশের ওপর। আটা-ময়দার মতো পণ্যের দামও ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে মোটা চালের দাম বাড়েনি। কিন্তু মাঝারি বা সুগন্ধি চালের দাম অনেক বেড়েছে। সার্বিকভাবে তেল, ডাল, ডিম, মুরগি ও মাছসহ ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়ার যে হার দিচ্ছে টিসিবি, তা বিবিএসের দেওয়া তালিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গেও মেলে না। বিবিএস যে মুদ্রাস্ফীতির তথ্য দিচ্ছেন তা বাস্তবসম্মত নয়, এমনকি বিজ্ঞানসম্মতও নয়।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমাদের ধারণা মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বিশ্ব বাজারে যে পণ্যের দাম বেড়েছে, সেই পণ্য এখনো দেশের বাজারে আসেনি। সেগুলো যখন আসবে, তখন নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে।’
অবশ্য অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, কোভিড পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি। কারণ এ দুটি খাত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের মূল্য দ্রুত বাড়ানোর সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হিসাব কষে বলা হয়েছে, মূল্য সমন্বয় অর্থাৎ দাম না বাড়ালে আগামী অর্থবছরে এই তিন খাতে ৫০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা শুধু ভর্তুকি হিসেবেই দিতে হবে। তাই দ্রুত বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানো দরকার।
অর্থ বিভাগ বলছে, মূল্য সমন্বয় না করলে আগামী অর্থবছরে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ভর্তুকি দিতে হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে গ্যাসের পেছনে ভর্তুকি বাবদ যাবে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে সারের ক্ষেত্রে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানো হলে ভর্তুকি কমতে পারে। তবে এখনই মূল্য সমন্বয় না হলেও বাজেট শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নতুন অর্থবছরের শুরুতে দাম বাড়ানোর দিকে সরকারকে এগোতেই হবে।
নতুন বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের হিসাবে চলতি অর্থবছরে খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৩২ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ বলছে, প্রতিবছরই ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, কৃষি ও জ্বালানি খাতে বর্ধিত হারে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ ছিল ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে ১২ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা বাড়ানো হয়।
অর্থ বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী বাজেটের আকার ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ- এ তিন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ তিন খাতে ব্যয় ধরা আছে এক লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সাশ্রয় করতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। অত্যাবশ্যকীয় খাত ছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান বন্ধ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রানির্ভর তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে। বেসরকারি খাতেও বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় করায় লাগাম টানা হয়েছে। কারণ পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যক্তি খাতে যেমন ডলার দিতে পারছে না, তেমনি নতুন এলসি খোলাও কমিয়ে দিয়েছে। আগের এলসির দেনাও শোধ করছে চড়া দামে ডলার কিনে।