পদ্মা সেতুর টোল
‘নিজেদের টাকার’ পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রায় শেষ। উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে এখন। গতকাল টোলের হারও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নের এ সেতু। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল টোলের হার সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাকে (আট থেকে ১১ টন) লাগবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। ফেরির দেড়গুণ বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদন পাওয়া টোল হার বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল হারের প্রায় দ্বিগুণ। এই টোল হার আরও কমিয়ে পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। আগামী পাঁচ বছরের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায়
আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য ৫ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা সরাসরি সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। আগেই ঢাকা-ভাঙ্গা পথে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে এই পথে যাতায়াতের সময় কমে এক ঘণ্টায় নেমে আসবে। পরিবহন নেতা, যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, সরকার নির্ধারিত টোল হারের মাধ্যমে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। যাত্রী পরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেওয়া শুরু করবেন পরিবহনকর্মীরা। একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা ২১ জেলায় পণ্য পরিবহনেও খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে বাড়তে পারে নিত্যপণ্যের দাম। যেহেতু নিজস্ব খরচে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে, তাই টোলের হার আরও কমানো যেত বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি আগামী ২৪ মে এ নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা। এ নিয়ে আমাদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার আগেই প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এখন দেখি বৈঠকে এ বিষয়ে কী আলোচনা হয়।’
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীও টোল হার কমানোর পক্ষে। তার মতে, পদ্মা সেতুর এই টোলের সঙ্গে যুক্ত হবে এক্সপ্রেসওয়ের টোল। এই হার সাধারণ মানুষের জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের টোল নির্ধারণের আগে সমীক্ষা করা দরকার ছিল। শুধু তাই নয়, গণশুমারির মাধ্যমে টোল চূড়ান্ত হওয়া উচিত। সেতু বিভাগ নির্ধারিত টোলের কারণে পদ্মা সেতুর সুফল বিঘিœত হতে পারে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, কার, জিপে ৭৫০ টাকা, পিকআপে ১ হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) ২ হাজার টাকা, বড় বাস (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা, ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ টনের অধিক থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ১০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা ও বড় ট্রেইলারে (৪ এক্সেলের বেশি) ৬ হাজার টাকা + প্রতি এক্সেল ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে টোল দিতে হবে।
গত ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতুর জন্য টোলের হার প্রস্তাব করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায় সেতু বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদনের পর গতকাল তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়। প্রজ্ঞাপন অনুসারে, সেতু বিভাগ থেকে যে টোলের হার প্রস্তাব করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তা হুবহু অনুমোদন দিয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, বিদেশি অর্থায়নে সেতু নির্মাণ হলে কত টাকা টোল ধার্য করা উচিত, সে বিষয়ে দাতাদের শর্ত বা পরামর্শ থাকে। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নীতিমালা নেই। সাধারণত সেতু হওয়ার আগে ফেরিতে যে হারে টোল নেওয়া হয়, সেতুতেও সেই হারে টোল নির্ধারণ করে থাকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মোট প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ঋণ মওকুফ ফান্ডের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে সেতু বিভাগকে আসল হিসেবে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে। অর্থাৎ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। প্রথম বছরই সরকারকে ৬০০ কোটি টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। টোল থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা। আয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। টোল আদায়ের জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের পেছনে ব্যয় করতে হবে। ফলে শুরুতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হবে। ১৫ বছর পর যানবাহন চলাচল বেড়ে গেলে এবং টোলের হার বাড়ানো হলে আয় করতে শুরু করবে সেতু বিভাগ।
জানা গেছে, টোল আদায়ের হার ঠিক করা হয়েছে যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাস ধরে। সে সময়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম বছরে পদ্মা সেতু দিয়ে দিনে প্রায় ৮ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। ৩৫ বছর পর যানবাহনের সংখ্যা দিনে ৭১ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ব্যয় বৃদ্ধি বা যানবাহন কম চললে টোলের হার নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ। যৌথভাবে কাজটি করবে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতুর নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু তৈরি করতে যত খরচ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টোল আদায় করা হবে।