মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ৫১৩ জন কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস চক্রে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের দুই কর্মকর্তা জড়িত। তাদের মধ্যে একজন ৩৪তম বিসিএসের ক্যাডার পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক মো. রাশেদুল। তবে তদন্তের স্বার্থে অপর কর্মকর্তার নাম এখনো জানায়নি পুলিশ। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. রাশেদুল, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবিব ও অফিস সহকারী মো. নওশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এ নিয়ে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৫ জনে। এর আগে প্রশ্নফাঁসে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও চাকরির পরীক্ষার্থী সুমন জোয়ার্দারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মাউশির এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের অধীনে থাকা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসে সারাদেশে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। গত শুক্রবার প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নেওয়ার সময় পথেই উত্তর বের করে তা নিজেদের লোকদের কাছে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় চক্রটি। এর পর তা হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পাঠানো হয় চাকরি প্রার্থীদের কাছে। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবিব প্রশ্নপত্র যে ছাপাখানায় ছাপা হতো তার দায়িত্বে ছিলেন। নওশাদ একটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া প্রশ্নফাঁসে জড়িত শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধান বলছে, গত শুক্রবার বেলা ১২টায় কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য মাউশি থেকে প্রশ্নপত্র বণ্টন করে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছায় দুপুর একটার দিকে। প্রশ্নপত্র নেওয়ার সময় মাউশির একজন শিক্ষা অফিসার (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার), একজন উচ্চমান সহকারী, কর্মচারী ও যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার একজন শিক্ষক ছিলেন। কেন্দ্রে নেওয়ার সময় মাউশির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দ্রুত তার উত্তর বের করেন। এর পর সারাদেশে তারা চক্রের সদস্যদের কাছে হোয়াটঅ্যাপে উত্তর পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে চাকরি প্রার্থীদের মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে উত্তর পৌঁছে যায়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এ চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস ছাড়াও মাউশিতে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ চাকরির পরীক্ষার্থী সুমন জোয়ার্দারকে গ্রেপ্তারের পর একে একে চক্রের অন্য সদস্যদের নাম বেরিয়ে আসে। সুমন স্বীকার করেন, খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে তিনি প্রশ্নপত্রের উত্তর পেয়েছেন। সুমন ছাড়াও সাইফুল আরও ৫ জন চাকরি প্রার্থীকে প্রশ্নের উত্তরপত্র পাঠান। সুমনকে সাইফুলের খোঁজ দিয়েছিল পটুখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল। ইতোমধ্যেই রাশেদুলসহ মাউশির দুই কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। এ ছাড়া গোয়েন্দা জালে রয়েছে বদরুন্নেসা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজের দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাউশির দুজন উচ্চমান সহকারী ও একজন কর্মকর্তার ব্যাপারেও অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশ।
জানা গেছে, মাউশির চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর বের করে পরীক্ষা শুরুর ৪২ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে প্রার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে চক্রের সদস্যরা। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চাকরি দিতে প্রতি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ধাপে ধাপে ৫ লাখ টাকা নেওয়ার চুক্তিও করেছিল চক্রটি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, গ্রেপ্তার সুমন জিজ্ঞাসাবাদে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে পাওয়া ৭০ নম্বরের প্রশ্নের সমাধান লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সাইফুলের মোবাইল ফোনে মাউশির একজনের কাছ থেকে উত্তরপত্র আসে। সাইফুল সেই উত্তর চাকরিপ্রার্থীদের কাছে পাঠায়। ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এ ছাড়া সাইফুল একদিনের রিমান্ডে রয়েছে। তার কাছ থেকেও প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে মাউশি কর্মকর্তারা বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলেও পরীক্ষা বাতিলের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে মাউশির নিজস্ব অনুসন্ধানও জোরদার নয়। বিষয়টিতে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে মাউশি। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কথা বলতে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের সঙ্গে বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।