বিশ বছর ধরে কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেটে নিয়মিত হাঁটছেন সাবেক বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের কান উৎসবে ৫০ বছর ছুঁই ছুঁই ঐশ্বরিয়ার কালোরঙা স্লিট গাউন যতটা না আলোড়ন ফেলেছে, এর চেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তার মুখের বয়সের ছাপ আর ঠোঁটের প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টি। এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ঐশ্বরিয়া রাই, দীপিকা পাড়–কোন, তামান্না ভাটিয়া, উর্বশি রাউতেলা ও পূজা হেগড়ে- ভারতের এই পাঁচ অভিনেত্রীর নাম ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে ছিল তাদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা। তাদের মধ্যে বয়স ও অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে এগিয়ে ঐশ্বরিয়া রাই। চেহারায় বয়সের ছাপ নিয়ে তিনি নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হয়েছেন।
কানের লালগালিচায় পৌঢ়ত্বের দোড়গোড়ায় পৌঁছানো ঐশ্বরিয়া রাইকে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ভক্তরা। আর শুধু ভক্তদের কথাই বা বলছি কেন, সাবেক এই বিশ্বসুন্দরী হয়তো নিজেও তার বয়সের স্বাভাবিক পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না। তাই হয়তো প্লাস্টিক সার্জারির শরণাপন্ন হচ্ছেন তিনি। অথচ পঞ্চাশের কোটায় চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে- এটিই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। শুধু তিনিই নন, নিজেকে আকর্ষণীয় ও তরুণ দেখাতে মডেলিং ও চলচ্চিত্র কিংবা বিনোদন জগতের তারকারা হরহামেশাই প্লাস্টিক সার্জারি করান। ৪৮ বছর বয়সী ঐশ্বরিয়া আজ যদি কম বয়সী কিংবা বেস্ট লুকিং দেখানোর চাপে না থাকতেন- তা হলে তিনি থাকতেন নির্ভার, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। তারকাদের পৌঢ়ত্বকে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না ভক্তরা। আর ভক্তের অসন্তুষ্টির মানে হলো গ্ল্যামার আকাশের কক্ষপথ থেকে তারকার খসে পরা, তারকাজীবনের পরিসমাপ্তি। তাই তারুণ্য আর গ্ল্যামার ধরে রাখতে প্রকৃতির সঙ্গে যেন অনেকটাই যুদ্ধ ঘোষণা করেন তারকারা।
জৌলুস আর যৌবন ধরে রাখার জন্য তারকাদের এ আয়োজন দেখে তাদের প্রতি কেবলই করুণা হতে থাকে আমার। তারকাদের মিলনমেলায় গ্ল্যামারের এই প্রতিযোগিতা আমার কষ্টকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। কারণ গ্ল্যামার, পোশাক আর মেকআপের জন্য মিলিয়ন ডলার খরচ করেও যে নিখুঁত সুন্দর হওয়া যাবে- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারকাদের খুঁত খুঁজে বের করতে উৎসুক কৌতূহলী চোখের কাছে প্রায়ই ধরাশায়ী হতে হয় তাদের।
দেশের ভেতর যে কয়েকটি বিনোদন জগতের তারার মেলায় অংশ নিয়েছি, এর অভিজ্ঞতায় বলতে পারি- এসব অনুষ্ঠানে গুণের স্বীকৃতির আয়োজনকে ছাপিয়ে যায় তারকাদের সুন্দর-সুন্দরী কিংবা অন্যের চোখে আকর্ষণীয় হওয়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যে শুধু নারী তারকারাই অংশ নেন, তা নয়। বহু পুরুষ তারকাও এরই মধ্যে প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছেন। এই ধরনের আয়োজনে তারকাদের ঝলমলে উপস্থিতির আড়ালে অনুভব করা যায় ব্যতিক্রমী সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তারকাদের নিজেদের তুলে ধরার টান টান উত্তেজনা। সাজটি হতে হবে সবার চেয়ে আলাদা, চোখ ধাঁধানো ও আকর্ষণীয়; জায়গা করে নিতে হবে বিনোদন পাতার শিরোনামে কিংবা পত্রিকার জমকালো অ্যালবামে। এই আশায় অনেক তারকা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস প্রস্তুতি নেন, একই সঙ্গে বিনোয়োগ করতেও কার্পণ্য করেন না।
অস্বাস্থ্যকর এই যুদ্ধ আজকাল ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। বন্ধুদের আড্ডা-আয়োজনে কিংবা গেট টুগেদারে আজকাল সাধারণের মধ্যেও দেখি সবচেয়ে সুন্দরভাবে নিজেকে তুলে ধরার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। একই সঙ্গে বয়সের বলিরেখাগুলোও ঢেকে রাখা চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৃষ্ট বন্ধুদের গ্রুপগুলোয় চলে নিজেকে তরুণ হিসেবে উপস্থাপনের বাহুল্য আয়োজন। মাঝবয়সী তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণ ক্লাবে পা রাখা ব্যক্তিরাও শামিল হন এই আয়োজনে। তা রীতিমতো দৃষ্টিকটু ও হাস্যকর হয়ে ওঠে কখনো কখনো। এ ছাড়া স্মার্টফোনে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা কিংবা বয়স কমানোর অ্যাপস তো আছেই। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি সব সময়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই চেষ্টায় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব অস্বাস্থ্যকর। মনে প্রশ্ন আসে, কেন আমাদের সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে? কেন কম বয়সী দেখাতে হবে আমাদের! অনর্থক এই উন্মাদনা আর প্রতিযোগিতা কি আমাদের ব্যক্তিজীবনের শান্তি আর স্থিতি কমিয়ে দিচ্ছে না?
সুন্দর হওয়ার এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্যের এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ অকারণে আমাদের অসুন্দর ভাবতে শেখায়। আয়নায় দেখা নিজের চেহারা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। এর পর চলে অসুন্দর থেকে সুন্দর হওয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। কারণ সৌন্দর্যের নেই কোনো সর্বজন স্বীকৃতি মানদ-। সৌন্দর্যের বিচার আপেক্ষিক। একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যের বিবেচনায় তা সুন্দর নাও হতে পারে। সৌন্দর্যের পেছনে ছোটার অর্থ অনেকটা মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। মাঝখান থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ কামিয়ে নেয় সৌন্দর্যের মিথ নিয়ে টিকে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
কখনো কখনো আমাদের স্বপ্নের তারকাদের মেকআপবিহীন কিংবা জৌলুসবিহীন যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়, এতে স্পষ্ট হয়- মেকআপবিহীন তারকারা হয়তো সাধারণের মতোই। তাদের মুখেও ব্রণের চিহ্ন কিংবা বলিরেখা থাকা স্বাভাবিক। তাদের চোখের চারপাশে থাকতে পারে ক্লান্তির কালো ছাপ, শরীরে জমতে পারে চর্বি কিংবা মাতৃত্বের চিহ্ন। চুলের বিজ্ঞাপনে তারকাদের পিঠে ঢল নামা চুলের বাহার হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেকি। কিন্তু আমরা তারকাদের সাধারণত্ব মানতে নারাজ। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠে সমালোচনার ঝড়। আর ভক্তদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে তারকারাও স্বয়ং যুদ্ধে নামেন। এ যেন এক দুর্ভেদ্য চক্র। ভক্তরা বুঝতে চান না তারকারাও মানুষ। তারাও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। গ্ল্যামার জগৎটি তাদের পেশাগত জগৎ মাত্র। তারকাদের সঙ্গে সাধারণের পাথক্যটি হলো, তারকারা এমন এক জগতে কাজ করেন- যেখানে তাদের ঘিরে থাকে লাইট, ক্যামেরা আর সংবাদমাধ্যম। বিষয়টিকে এভাবে দেখলে তারকাদের গ্ল্যামারকে নিজেদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে অশান্তিতে ভোগার কোনো কারণই জন্ম নেবে না।
নিজের সৌন্দর্য নিয়ে যারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই- আপনি সুন্দর। সুন্দর আপনার মুখশ্রী। বয়সের পরিক্রমায় জন্ম নেওয়া আপনার মুখের প্রতিটি বলিরেখা সুন্দর। সুন্দর আপনার চোখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়া বয়সের ছাপ, মুখের বাদামি তিল কিংবা মেছতার দাগ। কেননা যা আপনার সত্য, এতেই আপনি সুন্দর। জন কিটস বলেছিলেন- ‘যা কিছু সত্য, সেটিই সুন্দর। আর যা সুন্দর, সেটিই সত্য।’ তাই আসুন, আমরা সৌন্দর্যের মিথ্যা মরীচিকার পেছনে না ছুটে নিজের সত্যকে সুন্দর হিসেবে গ্রহণ করতে শিখি এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই।
নিশাত সুলতানা : লেখক ও উন্নয়নকর্মী