এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে স্টোভিডোরিং ব্যবসায় জড়িত ছিলেন, যা বর্তমানে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল মারা যান। ২০০০ সাল থেকে তাঁর সই জাল করে তাঁর স্টোভিডোরিং লাইসেন্সটি নিয়ে একটি পক্ষ ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করে দেন। এ নিয়ে আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা হয়েছে। অভিযোগ, ব্যক্তিমালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি দুইবার নাম পরিবর্তন করে এখন লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছে। সিআইডি ও পিবিআই’র পৃথক তদন্তে এই জাল জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
রাজিউল করিম চৌধুরীর পুত্র, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোরশেদ আরিফ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, রাজিউল করিম চৌধুরীর মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং (লাইসেন্স নম্বর ২/১৯৭২, তারিখ ০১.০১.১৯৭২) নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রথমে নাম পরিবর্তন করে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড করা হয়। সেখান
থেকে করা হয় জ্যাক শিপিং এন্ড লজিস্টিকস লিমিটেড। দুই দুইবার নাম পরিবর্তন করে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে। তাতে এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীকে ১০ শতাংশ শেয়ারও দেওয়া হয়েছে। আবার ওই শেয়ার রাজিউল করিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর জাল এফিডেভিটের মাধ্যম হস্তান্তরও দেখানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিতার প্রতিষ্ঠানটি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের ব্যাপারে মোরশেদ আরিফ চৌধুরী বিষয়টি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানান। এরপর পিতার প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা উদ্ধার ও জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে ৭ ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করেন। ফৌজদারি মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগ (সিআইডি) উভয়ই ফরেনসিক ল্যাব পরীক্ষার মাধ্যমে তৈরি প্রতিবেদনে জানায়, এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর নামে দেওয়া সমস্ত স্বাক্ষরই জাল। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মনজুর আলম এই জালিয়াতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মামলা তদন্তকালে তিনি আসামিদের পক্ষে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেন। মামলার বাদী সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে মোরশেদ আরিফ চৌধুরী তার কাছ থেকে এসব তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিষ্ঠানের মূল কাগজপত্র উদ্ধারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি আবেদন করেন। আদালত এই আবেদন গ্রহণ করে এ এইচ এম মনজুর আলমকে নোটিশ দিয়েছেন।
মোরশেদ আরিফ চৌধুরীর দায়ের করা মামলার এক ও দুই নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার এবং আনোয়ার হোসাইন মজুমদারের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের ভেন্ডরস এগ্রিমেন্টের (প্রতিষ্ঠান ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি) মূলকপি সরবরাহের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন। আদালত এই আবেদনটিও গ্রহণ করে দুই বিবাদীকে নোটিশ দিয়েছেন। এই মামলায় ৭ আসামির মধ্যে বর্তমানে তিনজন প্রায় তিন মাস ধরে কারাগারে আছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মনজুর আলম আমাদের সময়কে বলেন, রাজিউল করিম চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আদালত আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। প্রায় দেড় দশক আগের এই ঘটনা সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই মনে আসছে না। জাল স্বাক্ষর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিআইডি ও পিবিআই তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। এখন তাতে যদি দোষী প্রমাণ হই, তা হলে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। রাজিউল করিমের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, উনার নাম শুনেছি। তিনি সম্ভবত এ বিষয়টি নিয়ে আমার দপ্তরে কখনো আসেননি। কারণ তিনি দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা অস্ত্রভর্তি পাকিস্তানি ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানো ঠেকাতে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী। তিনি অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি জাহাজ বন্দরে আসার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জানে আলম দোভাষকে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে যান। এরপর তিনজন মিলে ছুটেন বন্দর এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় শ্রমিক ও যুবক সংগ্রহ করতে। তারা পরে হাজার হাজার লোক নিয়ে বন্দরের বিভিন্ন গেইটে অবস্থান নিলে তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র নামানো থেকে পিছিয়ে আসে পাক সেনারা। মাহবুবুল আলম ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল স্বাধীনতা’ নামক ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বইটিতে রাজিউল করিম চৌধুরীর এই অবদানের কথা বিস্তারিত লিখেছেন।
মনজুর আলম ওসেনএইড সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসেবে ব্যবসা করে আসছেন। তদন্তে জানা যায়, ২০১৮ সালে দুইটি চেক জালিয়াতি মামলায় মনজুর আলমের এক বছর করে সাজা হয়। সাজা অবস্থায় বাদীকে টাকা ফেরত দিয়ে তিনি ওই মামলা থেকে রেহাই পান।