বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা
(তৃতীয় পর্ব)
তবুও আমরা বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের কাছে হেরে যাই। আমার কাছে তখন বিস্ময়কর মনে হতো যে, শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের মতো ছাত্র ইউনিয়নের ঘাঁটিতে জিতেছিলেন কেমন করে। আমাদের ব্যাখ্যা ছিল যে, তার বিজয়ের পেছনে ছাত্রলীগ কাজ করেনি- কাজ করেছে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা।
আমাদের সহপাঠী-সহপাঠিনী যারা লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস তারা ’৭০-এর আগস্ট থেকেই নিয়মিত তৃতীয় বর্ষের ক্লাস করতে থাকেন। আমরা যারা রাজপথ, জহুরুল হক হল, মধুর ক্যান্টিন এসব জায়গায় সময় কাটাতাম তারা মাঝে মধ্যে কলাভবনের দোতলায় বাংলা বিভাগের বারান্দা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতাম। কোনো কোনো প্রিয় শিক্ষকের ক্লাসও করতাম। আমি স্মরণ করতে পারি না যে, শেখ হাসিনা কোন ক্লাসে বসে ক্লাস করছেন। তবে কলাভবনের দোতলার বারান্দায় তাকে নিয়মিত দেখা যেত। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারি যে, তিনি বিবাহিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে তিনি বদরুন্নেসা ও ইডেন কলেজ মাতিয়ে এসেছেন। বাংলা বিভাগে আমাদের ব্যাচে তার যুক্ত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত হলাম। বিশেষ করে ছেলেদের ছাত্রলীগ করা আর মেয়েদের ছাত্রলীগ করার ভারসাম্যটা আমরা পাব তেমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল। তিনি আসার পর আমাদের বিভাগে একটি নির্বাচন হয়। কিন্তু আমরা তাতেও হারি। আমাদের তখন ধারণা বাংলা বিভাগে ছাত্রলীগ কোনোদিন জিতবে না। তবে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এটুকু স্মরণ করতে পারি যে, বাংলা বিভাগের শেখ হাসিনা অতি সাধারণ বাঙালি ঘরের বধূ-কন্যা হিসেবে পুরো বিভাগের জন্য একটি দৃষ্টান্ত ছিলেন। ’৭০ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু শেখ হাসিনা যে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে সেটি আমরা টেরই পেতাম না। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আসতেন। গায়ে গয়নার কোনো চিহ্ন দেখতাম না। আর পুরো বিভাগে আড্ডা দিতেন অতি সাধারণ ছাত্রীর মতো। আমাদের ব্যাচের জন্য শেখ হাসিনাকে সহপাঠিনী হিসেবে পাওয়াটা কেবল অপ্রত্যাশিতই ছিল না, গৌরবেরও ছিল। তবে একটি মজার বিষয় আমরা লক্ষ করেছি, তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন বা সরকার গঠন করেন তখন আমাদের ব্যাচের ছাত্রলীগ করত তেমন কাউকে তার আশপাশে দেখা যায়নি। বরং আমাদের ব্যাচেরই যারা ছাত্র ইউনিয়ন করত বা আমাদের সিনিয়র যারা তার সঙ্গে পড়াশোনা করতেন তাদেরও বেশিরভাগ তৎকালে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। এটি সম্ভবত এজন্য যে, ব্যক্তিগত সম্পর্কটাকে তিনি অনেক মূল্য দিতেন। সত্তর সালের প্রেক্ষিতটি সবারই জানা এবং আমরা যারা তখন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম এবং যাদের শেকড় গ্রামে ছিল তারা সবাই সত্তরের নির্বাচনের জন্য গ্রামে চলে যাই। আমার নিজের গ্রামে যাওয়াটা একেবারেই লড়াই করা ছিল। কারণ আমার থানায় তখন আওয়ামী লীগ বলতে তেমন বড় কোনো সংগঠন ছিল না। খালিয়াজুরী সদরে সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার নামের একজন যুবক ছিলেন, যিনি আওয়ামী লীগ করতেন। পুরো অঞ্চলটা হিন্দুপ্রধান এবং তাদের সঙ্গে সিপিবি ও ন্যাপের সম্পর্ক ছিল বেশি। আমাদের আসনে ন্যাপের একজন প্রার্থীও ছিলেন। তিনি তার কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে বেশ দাপটের সঙ্গে আমাদের নৌকার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তবে নির্বাচনে আমরা এমপি ও এমএনএ দুটিতেই জিতে যাই। এর পর ’৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের পর আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। ’৭২ সালে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াই বন্ধ করে দিই। ফলে তখন আর শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনো পথ খোলা থাকেনি।
যাহোক খুব সঙ্গতকারণেই ’৭০-৭১ সালে তো বটেই শেখ হাসিনা ’৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। ‘৭৫-এর পর কঠিনতম সময় পার করতে করতে এক সময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় শেখ হাসিনা যখন নতুন করে আওয়ামী লীগ গড়ে তোলেন তখনো তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমি স্মরণ করতে পারি যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে পরের দেখাটি হয় ১৯৮৩ সালে। সেই বছরের মার্চ মাসে আমি মাসিক নিপুণ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করি। একটি সিনেমা পত্রিকাকে পারিবারিক সাময়িক পত্রিকায় রূপান্তর করার জন্য আমি তখন আপ্রাণ চেষ্টা করি। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ গড়ে ওঠে বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরে। নিহত জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নীকে নিয়ে তখনো কোনো পত্রিকায় কোনো ফিচার বা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়নি। নাসির আলী মামুন বেগম জিয়ার ছবি তোলেন এবং কবি অসীম সাহা তাকে কেন্দ্র করে প্রচ্ছদ কাহিনি তৈরি করেন। অসীম সাহা বেগম জিয়ার সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। নিপুণ-এর প্রথম সংখ্যাটি সুপারহিট হয়। হাজার হাজার কপি বিক্রি হওয়ার প্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এপ্রিল ৮৩ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি করা হবে শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে। শেখ হাসিনার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হলো। জানা গেল যে, তিনি মহাখালীতে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু তার সাক্ষাৎকার ছাড়া তো প্রচ্ছদ কাহিনি হবে না। আমার ওপরই দায়িত্ব পড়ল সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আমি তার মহাখালীর বাসায় গেলাম। তিনি খুব সহজেই চিনলেন। বসে আলাপ করা শুরু করতেই আমি আমার পত্রিকার একটি কপি দিলাম এবং সেটিকে নিয়মিত প্রকাশ করব সেটি জানালাম। প্রসঙ্গত আমি তার একটি সাক্ষাৎকারের কথা জানালাম। তিনি নিপুণ-এর নাম শুনেই রেগে গেলেন। ‘আপনি খুনি জিয়াউর রহমানের মূর্খ বউটাকে কভার ছবি করেছেন, আর সেই পত্রিকাকে আমি সাক্ষাৎকার দেব? আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে জানাতে চাইলাম যে, পত্রিকাটি রাজনৈতিক নয় এবং খালেদার সাক্ষাৎকারও রাজনৈতিক নয়। বস্তুত এটিও বলতে চাইলাম যে, আমি আপনার রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। তিনি বললেন, আমি এই পত্রিকার জন্য কথা বলতে পারি না- আপনি উঠতে পারেন। বুঝতে পারলাম, তিনি ভীষণ রেগে গেছেন। আমি ওঠার ভঙ্গি করে বললাম, কথা না বলেন ভালো কথা, চা খাওয়াবেন না? তিনি হেসে ফেললেন। বললেন বসেন। আমি চা বানিয়ে আনি। আমিও বসে গেলাম। তিনি নিজের হাতে চা বানালেন এবং দুজনের হাতে কাপ নিয়ে আমরা ছোটখাটো কথা বলতে শুরু করলাম। অতীতের স্মৃতি, বাংলা বিভাগের কথা ছাড়াও আমাদের সহপাঠিনী রোকেয়া, মমতাজ আপার কথা হলো। কথা হলো সহপাঠিনী রোকসানাকে নিয়ে। তিনি জানলেন ক্লাসের প্রথম হওয়া রোকসানা আর আমি সংসার পেতেছি। সন্তানদের নিয়ে কথা হলো। সঙ্গে সঙ্গে একটু রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলো। আমার আলাপের ধরন দেখেই তিনি বুঝলেন আমি সাক্ষাৎকারটা নেবই। অনেকক্ষণ আলাপ করে ছবি তুলে নিপুণ-এর ’৮৩ সালের এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি করলাম। বাংলা বিভাগের পর শেখ হাসিনার সঙ্গে সেটাই প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। তার পর মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হতো। আমার জীবনটাও নানা খাতে প্রবাহিত হতে হতে ’৮৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে এসে পৌঁছায়। সেই সময়েই শেখ হাসিনা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্থির করেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কম্পিউটারের যুগে প্রবেশ করাবেন। সেই মোতাবেক তিনি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মেকিন্টোস কম্পিউটার ও একটি লেজার প্রিন্টার কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমার দায়িত্ব পড়ে শেখ হাসিনাকে বাংলা টাইপিং শেখানোর। তিনি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে কম্পিউটারের নানা বিষয় শিখতেন এবং আমি তাকে ইংরেজি কোন বোতামে কোন বাংলা অক্ষর বা কোন যুক্তাক্ষর কেমন করে বানাতে হবে সেটি শেখাতাম। তখন কোনো কোনো সময় তিনি নিজে টাইপ করে দলের প্রেস রিলিজ মিডিয়ায় পাঠাতেন। তখন তো দূরের কথা, এর পরও বহু বছর বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিবিদ এমন করে কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করেননি বা কম্পিউটারের সঙ্গে মিতালিও করেননি। তার একটি বাড়তি সুবিধা ছিল যে, তার ঘরেই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আছে। তারা তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেন। আমি অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারি যে, তিনি একজন প্রযুক্তিমুখী মানুষ বলেই আজ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রূপান্তরের পথের দেশ বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। (চলবে)
মোস্তাফা জব্বার : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলাম লেখক