মানুষ জন্ম নেওয়ার পরে তার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বিভিন্ন শব্দের সাথে পরিচিত হয়। যেমন : দাদা, দাদি, বাবা, মা, ব্যথা, উহ্, আহ্ ইত্যাদি। তারপর বয়সের অনুপাতে তার কাছে গড়ে ওঠে বিশাল শব্দ ভাণ্ডার, মানুষ শিখে যায় অনেক কিছু।
আশির দশকে আমার নিজ জেলা শহর থেকে ঢাকায় আসা যাওয়া শুরু হয়। ঢাকায় এসে তৎক্ষণাৎ দুইটি নতুন শব্দের সাথে পরিচিতি হই। এক. জঙ্গি এবং দুই. পলি।
জঙ্গি শব্দটির সাথে আমি পরিচিত হই একটি চলন্ত বাসের গায়ে লেখা দেখে। লেখা ছিল পীরজঙ্গী মাজার হইতে গুলশান বনানী- ৬ নম্বর। এই বাসগুলো তখন মুড়ির টিন নামে পরিচিতি ছিল। যা কমলাপুর থেকে গুলশান ও বনানীতে চলাচল করতো। ৬ নম্বর বাস এখনো কদাচিত চোখে পরে। আমার বয়স তখন হয়তো ১৮। অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করেছি জঙ্গি মানে কী? কিন্তু সঠিক উত্তর পাইনি। তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গী শব্দের অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি, এখনো এর সঠিক উত্তর পাইনি। তবে এটা পরিষ্কার এরা খুনি। এরা নিরস্ত্র মানুষকে তাড়া করে, একের পর এক হত্যা করে বিনা কারণে। যাহোক জঙ্গীরা গত প্রায় ৪০ বছরের কার্যক্রম নিয়ে হাজির গুলশানে। খোদা রহম করুন ওরা যেন বনানীতে না যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে পারসি শব্দ জংগ এর অর্থ যুদ্ধ। সেই অর্থে জঙ্গী শব্দের অর্থ যোদ্ধা বা যুদ্ধ করে যে। অতি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের পরে যে সাহিত্যকর্ম এ অঞ্চলে জনপ্রিয়তা লাভ করে তা হলো পুঁথি সাহিত্য। পুঁথি সাহিত্য আমরা ২ ধরনের আদল দেখতে পাই। ১. জংগ পুঁথি। ২. সাধারণ পুঁথি।
১. জংগ পুঁথি: জংগ পুঁথিতে আমরা ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা শুনতে পাই। বিশেষ করে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের যুদ্ধের কাহিনী ইত্যাদি।
২. সাধারণ পুঁথি : যেখানে মূলত মানব জীবনের বিভিন্ন বিষয় প্রেম কাহিনী, প্রকৃতির বর্ণনা, চাওয়া পাওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে।
জংগ শব্দটি মোঘল সম্রাটদের মুখে যুদ্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই নিরবিষ শব্দটি এখন সময়ের বির্বতনে একটি বিষাক্ত শব্দ। এছাড়া মধ্য যুগে জংগ সাহিত্য বলে এক ধরনের সাহিত্য গড়ে উঠেছিল যেখানে মুসলমান ইতিহাসের বড়ো বড়ো বীরদের যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হতো। জঙ্গী শব্দ তখন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো না। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের অনুসন্ধান অনুসারে অনেক শব্দ ব্যবহৃত হতে হতে তার সঙ্গে নেতিবাচক অনুসঙ্গ যুক্ত করে অনেক সময় নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জঙ্গী শব্দের ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলা নট শব্দের অর্থ নৃত্য। এই নৃত্যকর্মে আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে যারা থাকতেন তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মর্যাদা পেতেন। এমনকি মোঘল সম্রাজ্যের হেরেমেও এ সকল মেয়ে ছিল অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নৃত্য অর্থে ইতিবাচকভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন: “নগরের নটী চলে অভিসারে যৌবন মদে মত্তা”।
কিন্তু সময়ের বির্বতনে নৃত্য শব্দের সাথে সম্পর্কিত নারীরা ক্রমে ক্রমে অসামাজিক কাজে নিয়োজিত হওয়ায় নটী শব্দটি তার ইতিবাচকতা হারিয়ে এর নেতিবাচক অর্থে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। জংগ শব্দের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জংগ এখন যুদ্ধ নয় এটি, একটি নেতিবাচক শব্দ। নিরবিষ শব্দ জংগ এখন একটি বিষাক্ত শব্দ।
যাহোক, দেশবাসীর মন থেকে গুলশান ট্র্যাজিডির কথা এখনো মুছে যায়নি। সেই ঘটনা জেনেছিলো সারা বিশ্ব। সেই দিনটি এলেই আমরা সকলেই হতাশ, মর্মাহত, বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং শোকসন্তপ্ত হই। আমরা জাতীয় বীরদের পরিবারকে সহমর্মিতা জানাই। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসীব করুন।
জংগী নির্মূলে সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এমনকি গুলশানে জংগীবাদে সরকারের দ্রুততম পদক্ষেপ ছিল প্রশংসার দাবিদার, বীর শহীদদের প্রতি আমাদের সালাম জানাই। সামাজিকভাবে এটা অঙ্কুরে দমন করা সম্ভব। প্রতিটি পরিবার যদি তাদের সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখে তবেই হতে পারে এ ধরনের সমস্যার অঙ্কুরের বিনাশ, কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে পরিবারের বহুমাত্রিক রূপ। অবশ্য রাষ্ট্রেরও আরও কিছু ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের এ সর্ম্পকে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
অধুনা জংগী তৎপরতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্রদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। কিন্তু সবশেষ ঢাকার বিখ্যাত ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ততা দেশবাসীকে হতাশ করেছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করা ছাত্রদের পিতা-মাতা স্কুল কলেজের শিক্ষকসহ সকলেই হতাশ, স্তম্ভিত, নির্বাক। প্রশ্ন উঠেছে ইসলামকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের রগকাটা, গলাকাটা, সন্ত্রাস সৃষ্টি করার ইতিহাস সেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হতে শুরু করে, আশির দশকে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কায়দায় প্রসার লাভ করে। এর সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্র জড়িয়ে পড়ে একের পর এক। বিশেষ করে ৫ মে মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়। যদি প্রশ্ন করা হয় মাদ্রাসার ছাত্ররা এতে জড়িয়ে পড়ে কেন? মোটা দাগে উত্তর হলো-
১. মাদ্রাসায় সাধারণত এতিম, অসহায়, দিনমজুর, প্রান্তিক, চাষী, বেকার পরিবারের সন্তানেরা ভর্তি হয়। তাদের পরিবারের স্নেহের অভাব আছে। পারিবারিক ও মানসিকভাবে এরা দুঃখী। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন ও পরিবারের অভাব অনটনের সাথে এদের গভীর সম্পর্ক।
২. শৈশব থেকে মাদ্রাসার ছাত্রদের ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হয় সেটা ভালো, কিন্তু সেই শিক্ষার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কালের আরবি সংস্কৃতিও তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষা গ্রহণের সময় মধ্যযুগীয় আরবি সংস্কৃতি তাদের মাথায় ঢুকে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে তারা মধ্যযুগীয় আরবি সংস্কৃতি ও বর্তমান সংস্কৃতির মধ্যে বাস্তব জীবনে এসে বিরাট পার্থক্য অনুধাবণ করতে পারে। লক্ষ্য করবেন তাদের পোশাক-আশাক, চাল-চলন আমাদের থেকে আলাদা। তাদের পাজামা-পাঞ্জাবি ও সাধারণ মানুষের মতো না। এমনকি প্রতিনিয়ত কেউ কেউ মরুভূমির পোশাক পরে চলাফেরা করে। যেটা আমাদের আবহওয়ায় বেমানান। সামাজিকভাবে এরা এদের চিন্তা-চেতনায় আমাদের থেকে ভিন্নতর। তারা সময় পেলে তাদের চিন্তা-চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করাতে চায়।
৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো পড়ালেখা শেষে এরা তেমন কোনো ভালো চাকুরি পায় না। এবং অভাব অভিযোগ তাদের পরর্বতী বংশধর পর্যন্ত চলতে থাকে। এ জীবনে কিছু হলো না বা পেলো না ভেবে পরকালে সবকিছু পাবে এই আশায় ও আশ্বাসে তারা কাজ করে যায় একের পর এক।
৪। কাউকে খুন করার দৃশ্য আমি দেখিনি। যেনো সেটা কোনো দিন না দেখি । সিনেমায় অনেক খুনের দৃশ্য দেখেছি, লক্ষ্য করবেন খুনের দৃশ্যে খুনি চিৎকার করে ও বিভিন্ন বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে। প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এটা ওরা করে? বিষয়টি হলো চিৎকার করে খুনি তার মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে সেটা তার স্বাভাবিক মস্তিস্কের কার্যক্রমকে অভিনিবেশ করে তার মস্তিষ্কে একই উদ্দেশ্যে অর্থ্যাৎ খুনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। কারণ সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ খুন করে না বা করতে পারে না । এ বিষয়ে নিউরোলোজির ডাক্তাররা আরও ভাল বলতে পারবেন। এবার একটি ভিন্ন বিষয়ে কথা বলি, আমরা যে শব্দ উচ্চারণ করি সেখানে শব্দের সাথে সময়ের একটি গাণিতিক সম্পর্ক আছে যেটাকে সঙ্গীতের ভাষায় মাত্রা বলে। ধরুন একটি শব্দ উচ্চারণ করতে ১৬ সেকেন্ড সময় লাগে। এটাকে ১৬-১৫ -১৪-১৩-১২-১১-এভাবে ১৬ মাত্রার উচ্চারণ করা যেতে পারে। তবে বড় বড় গুণি উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী এটাকে শুনেছি ১২-১৪ মাত্রা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারেন।
যাইহোক প্রসঙ্গে আসি, ৫ থেকে ৭ বছরের বাচ্চাদের যখন কুরআন শরীফ পড়ানো বা মুখস্থ করানো হয়, তখন এই ব্যাপারটি প্রাধান্য পায়। দেখবেন ওরা চিৎকার করে পড়ে। এটা এক ধরনের অভিনিবেশ যেটা তার মস্তিষ্ককে সাধারণ মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। তাই তাদের চিন্তা-চেতনা ধীরে ধীরে আমাদের থেকে আলাদা হতে শুরু করে এবং আলাদা হয়ে যায়।
আমার মনে হয় আপনারা বুঝবেন যে, আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সমাজকে তাত্ত্বিকভাবে ভাগ করে ফেলেছে, সমাজের এক শ্রেণি শিক্ষায় উন্নত হয়ে সকল ধর্মের মানুষের সাথে মিলে মিশে বাস করছে। অন্য শ্রেণি অভাব অনটন, মনস্তাত্ত্বিক নিপীড়ন আরেক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে আছে সমাজের প্রতি ক্ষোভ, এ সমাজকে ভাঙার প্রত্যয় আর এ সকল মানুষকে আল্লাহর নামে ব্যবহার করা, অতি সহজ কারণ তারা তো আগে থেকে প্রস্তুত। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এদেরকে ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে ,কখনও খানকা, কখনো মুরিদ , কখনো আশেকানি বা কখনো জঙ্গী হিসেবে।
আশা করছি রাষ্ট্র সরকার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের সকলে মিলে এসব অসম বণ্টনের ফসলকে, আধুনিক উৎপাদনমুখি শিক্ষা ধর্মের পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনবে।
জঙ্গী উত্থান এবং এই সকল মানুষকে আল্লাহর নামে ব্যবহার করার প্রয়াস আজকের নয় এমনি হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সময়ে এই রূপ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীবাদ বা খানকার নামে উত্থান হয়েছিল। আবু বকর (রাঃ) সেটাকে কঠোর হাতে দমন করেছিলেন এবং মদিনার সকল মুসলমানকে এক করেন, সেই জন্য ই হযরত আবু বকর (রাঃ) কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়। এমনকি মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলেও এ ধরনের জঙ্গী তৎপরতার কথা আমরা শুনেছি যা সম্রাট জাহাঙ্গীর কঠোর হস্তে দমন করে অমর হয়ে আছেন। আশা করছি আমরাও বর্তমান সরকারকে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় দেখতে পাবো।
এ বার আশা যাক ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্ররা কেন জংগীবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে?
এখানে আরেকটু বিস্তারিত বলতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ক্রম বিন্যাস আছে সেগুলো মোটামুটিভাবে পাঠশালা- মক্তবভিত্তিক, পাঠশালাভিত্তিক পড়াশোনা পরবর্তী পর্যায়ে আলীগড় আন্দোলনের পরে আস্তে আস্তে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সিলেবাসে পরিণত হয় এবং মক্তবভিত্তিক পড়ালেখা, তফসির, হাফেজি এবং আলেম, ফাজেল , টাইটেলভিত্তিক পড়াশোনায় পরিণত হয়।
লক্ষ রাখা দরকার, আজ থেকে ১৫০-২০০ বছর আগে যারা মক্তবভিত্তিক পড়াশোনা ছেড়ে আধুনিক পড়ালেখায় যোগ দিয়েছিলেন তারা চাকুরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য , সামাজিক ও রাজনৈকিতভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন আর মাদরাসাভিত্তিক পড়ালেখা করা ছেলেমেয়েরা পিছনেই পড়ে আছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিবর্তনে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা লাভবান হলেন। তারপর বেশ কিছু সময় কেটে গেলো, পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের মধ্যবিত্তরা তাদের বাচ্চাদের পিওর ইংরেজি শিক্ষায়-শিক্ষিত করাতে লাগলেন। আধুনিক পিতা মাতারা ভাবলেন এখন বিশ্বয়ানের যুগ, তাই বাচ্চাদের এই বিশ্বয়ানের যুগে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করলে নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা পুরানো শিক্ষার মান ভেঙে দেশে ও বিদেশ আরও ভালো করবে। ছাত্র এবং পরিবার সকলেই লাভবান হবে। বাস্তবে কি তা হয়েছে? ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিদেশে ভালো করছে কিন্তু দেশে কি তারা ভালো করতে পেরেছে? এমনকি এরা দেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে? দু’একটি উদাহারণ বাদে যদি প্রশ্ন করি-
আমাদের দেশে কি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বা মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত কেউ আছেন সরকারের উচ্চ পদস্থ আমলা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সামারিক বাহিনী বা বিচার বিভাগে অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, রাজনীতিতে, সাংবাদিকতায় বা কোনো লাভজনক পদে?
যে উত্তর আপনারা দেবেন- সেটা হচ্ছে, না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতো লেখাপড়া করে যদি কোন ছাত্র দেশে চাকুরি না পায়, সমাজের কোন মর্যাদাপূর্ণ স্থানে তাকে না দেখা যায় তবে সে কি করবে বলুন। হয়তো অনেক বাংলা মিডিয়ামের পণ্ডিতরা বলবেন ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্ররা ফার্মের মুরগি, পড়ালেখা করে না, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি ইংরেজি মিডিয়ামের ও লেভেলের বইগুলো একবার দেখেন তারা বাংলা মিডিয়ামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়ে। আমার দুই ছেলে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, বড় ছেলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলেকে আমি মাঝে মাঝে গণিত দেখিয়ে দেই বা তার পড়ালেখার খোঁজখবর নেই। তার অংক বই দুইটি পত্র, পিওর ম্যাথ, অ্যাডভান্স ম্যাথ, দুই বইয়ের মোট ১৮১৬ পৃষ্টা , বাংলা মিডিয়াম স্কুলে দুইটি গণিত বই মাত্র -৫৮৫ পৃষ্ঠা। পাঠক বুঝেন ওরা কতো বড় সিলেবাস ফেস করে ও লেভেলের উত্তীর্ণ হয়। এরপরে যদি ও লেভেলের ছাত্ররা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো সময় এবং বাবার টাকা খরচ করে সম্মান ২য় অথবা ৩য় বর্ষে এসে দেখে যে তার পড়ালেখা মূল্যহীন তখন তার মস্তিস্ক ও মননে পরিবার ও সমাজ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তো আসতেই পারে।
ইংরেজি ও ধর্মভিত্তিক পড়াশুনা করা ছেলে মেয়েদের মনের যখন এই অবস্থা তখন দুর্বৃত্তরা তাদেরকে ব্যবহার তো করবেই। এই ছেলেমেয়েরা হচ্ছে একটা তৈরি মাঠ, বীজ দিলেই বাম্পার ফলন।
আশা করছি, সকলে আমাদের সন্তানদেরকে কীভাবে, কতো সহজভাবে তৈরি মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা পরিষ্কার করে বুঝবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে তা হলে এখানে রাষ্ট্রীয় করণীয় কী?
একজনের মস্তিস্কের চিন্তায় হয়তো এ সমস্যার সমাধান হবে না কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে দু-একটি সুপারিশ তো করতেই পারি।
১। ইংরেজি ও ধর্মভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবন শেষে তাদের কর্মসংস্থান করা বা প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, আমরা কি কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবো এদেশে কয়টি ইংরেজি মাধ্যম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, কতজন অ খবাবষ, আলেম, ফাজেল, টাইটেল পাশ করে? কতজন চাকুরি পায় , কতো জন বেকার? কতো জনকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়? এ উত্তর আমার কাছে নেই, রাষ্ট্রের কাছে হয়তো আছে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, আমার বাচ্চাদের স্কুলের একটা নোটিশ বোর্ডের কথা। বছর চারেক আগে আমি আমার বাচ্চাদের স্কুলের নোটিশ বোর্ড দেখছিলাম, সেখানে দেখলাম একটা নোটিশ। নোটিশটি ছিলো এরকম, ( যদি আমার স্মৃতি বিভ্রম না হয় থাকে, ২০১২ সালের কথা বলছি ) আপনার স্কুলের এতোজন ছাত্র অ খবাবষ করেছে। তার মধ্যে এতোজন বিলেতে শিক্ষা ভিসার জন্য আবেদন করেছে, বাকী এতোজন শিক্ষা ভিসার জন্য আবেদন করেনি, তারা কেন আবেদন করেনি, তাদের কী সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি ছিল ব্রিটিশ হাই কমিশনের থেকে পাঠানো আর মুল চিঠি ছিলো ব্রিটেনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। দেখুন ব্রিটিশরা আমাদের ছেলে মেয়েদের কথা কত ভাবে, যদিও পণ্ডিতেরা হয়তো এটাকে ব্রেইন ড্রেইন বলবেন বলুক, বিলেতিরা তো আমাদের সন্তানদের জন্য ভাবছে! আর আমরা কতটুকু তাদের কথা ভেবেছি। প্রসঙ্গত এ ধরনের চিঠি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমার মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য এসেছে কিনা আমার জানা নেই।
২। চাকুরি ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্ন এমনভাবে করা যায় কিনা সেখানে সকল শিক্ষায় শিক্ষিতরা অংশগ্রহণ করতে পারে। যেমন ধরুন যদি বিসিএস পরীক্ষা প্রশ্ন, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ এইটা কোন কবিতা, কার লেখা অথবা কাহ্ণপা, হবপ্পা, লুইপা কী করতেন? ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি উঠরে কে লিখেছেন? একটা ইংরেজি মাধ্যম বা ধর্মীয় মাধ্যমের কতোজন ছাত্র সেটা উত্তর দিতে পারবে ? সেক্ষেত্রে সকলে উত্তর দিতে পারে এমন ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সেটা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। আমরা যেদিন সকল ছাত্রছাত্রিকে সরকারি চাকুরি, সমাজের বিভিন্ন লাভজনক পদে দেখতে পাবো তখন এদের একটা পুনর্বাসন হবে।
৩। দেশের সকল ছেলে-মেয়েকে বোঝাতে হবে যে, সমাজে একটা চাকুরিই একমাত্র সম্মান এনে দিতে পারে না, একজন ভালো খেলোয়াড, শিল্পী, চিত্রকর, সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী হয়েও দেশের সেবা করা যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাজের প্রতিষ্ঠিত তাত্ত্বিকদের এনে সেমিনার করা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে এদের মনস্তাত্ত্বিক সেবা দেওয়া যেতে পারে।
৪। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক বন্ধন তেমন শক্ত নয়। একান্নবর্তী পরিবার এখন ধ্বংসের পথে। যাই হোক পরিবার থেকে নিজেকে ভালোভাবে শিক্ষা, পরিবারকে ভালোবাসার শিক্ষা দেওয়া দরকার।
ওই সকল যে সমস্ত ছেলে মেয়ে জঙ্গী হয়েছেন বা কীভাবে আছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি- বাবা তোমরা সুস্থ জীবনে চলে আসো, নামাজ পড় , কোরআন পড়ো।
জংগী কাজে নিয়োজিতদের উদ্দেশ্যে অতি বিনয়ের সাথে বলতে চাই জঙ্গী কার্যক্রম ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ তার পবিত্র কোরআন এ করিমে বলেছেন-
হে মুসলমানগণ ! এই দীন রহমতের দীন এই নবী (সাঃ) রহমতের নবী (সাঃ) এই শরীঅত রহমতের শরীঅত। কোন সন্দেহ নাই যে, এই দীনের পয়গম্বর (সাঃ) বিশ্ব মানুষকে বিপর্যয়, অশান্তি , ত্রাস ও খুন থেকে মুক্ত করে এক শান্ত নিরাপদ বিশ্ব বানানোর জন্য তশরিফ এনেছেন । যেমন আল্লাহ সুবাহানাহু তাআলা এরশাদ করেন : “ আমি আপনাকে সমস্ত জাহানের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি । “(সুরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
হে মুসলমানগণ ! একজন মানুষ সে যাই হোক না কেন , তার জন্য পৃথিবীতে নিরাপদ জীবন ধারণের অধিকার স্বীকৃত। সে মুমিন হোক কিংবা কাফির হোক কিংবা ফাসেক হোক । অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে খুন করা কিংবা তার সম্পদ গ্রাস করা কিংবা তাকে অপমানিত করা হারাম। কুরআন বলছে, আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণে তাকে হত্যা করো না। ( বনি ইজরাঈল : ৩৩) এবং আরো এরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল । (সুরা মায়েদা : ৩২)
ওহে মুসলমানগণ ! আপনারা সন্তান সন্তুতির বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী ও সাবধান থাকুন তাদেরকে সুন্দর চরিত্রের শিক্ষা দিন । তাদের বিষয়ে সজাগ থাকুন যে আপনার সন্তানকে আপনার চোখ ফাঁকি দিয়ে যেন সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিতে না পারে। সন্ত্রাসীরা এই অবুঝ সরল কিশোরদেরকে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে ভাগিয়ে নিয়ে নানা অপকর্মের প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গী বানাতে চেষ্টা করে থাকে।
এছাড়া জঙ্গী কার্যক্রম বৌদ্ধ ধর্মেও স্থান পায় নাই। বৌদ্ধ ধর্মে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পরে জঙ্গী চিন্তা ধারায় মংরা সাধারণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের ওপর আক্রমণ করে জঙ্গী কায়দার, প্রথমে অসহায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালিয়ে যায় বিভিন্ন স্থানে, ইতিহাসের পরিক্রমায় এখন মংদের অস্তিত্ত্ব নাই সাধারণ বৌদ্ধরাই বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছে।
এমনকি হিন্দু ধর্মে অসুর যখন স্বর্গ থেকে মর্তে এসে ত্রাস হত্যা লুট আর অন্যায় করছিলো তখন ...... স্বর্গ থেকে সরস্বতী এসে তাকে ধ্বংস করে। খৃষ্টান ধর্মেও জঙ্গী হামলার ফলে প্রায় ২০০ বছর যুদ্ধ হয় ঢ়ৎড়ঃবংঃধহঃ ও রোমান ক্যাথলিক চার্চ, অথডক্সদের মধ্যে কিন্তু জঙ্গীরা কখনও ইতিহাসে স্থায়ী হয় নাই। জঙ্গীরা, তোমরা আমার দেশের সন্তান, তোমরা অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে এসো। তোমার মা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে তোমার জন্য কাঁদছেন, বোন জানালা দিয়ে চেয়ে আছেন কবে তুমি আসবে, আর তোমার বাবা বয়ে বেড়াচ্ছেন বুক চাপা কষ্ট, তোমরা জানো, তোমরা ফিরে এলে কতো খুশি হবে তোমার ছোট বেলার খেলার সাথী, তোমার আত্নীয়-স্বজন, ফিরে এসো তোমরা আলোর পথে , দেশ তোমাদের বরণের অপেক্ষায়। সব ভুলে মূল স্রোতে ফিরে এসো আমাদের মানিকেরা। দেশ তোমাদের মতো ছেলেদের লাশ আর দেখতে চায় না । আমরা দেখতে চাই তোমরা ভালো হয়ে মূল স্রোতে চলে এসে দেশকে সেবা করো নিজের ভবিষ্যত গড়ো আর দশ জন সাধারণ মানুষের মত করে।
এবার পলির কথা বলি। এ পলি সে পলি নয় এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট সুন্দরী এবং সুনামধন্য স্যুটার পলির কথা বলছি না। এ পলি ভিন্ন রকম।
যাই হোক পাঠক আগেই বলেছি আশির দশকে ঢাকায় এসে আমি দুইটি শব্দের সাথে পরিচিত হই একটি জংগি অপরটি পলি-
রিক্সায় যখন ঢাকায় ঘুরতাম তখন অনেক জায়গার দেখতাম লেখা আছে রাসমোনো পলি ক্লিনিক, বা এটা সেটা পলি ক্লিনিক- আমি ভাবতাম পলির বাবা কতো বড়লোক তার এক মাত্র মেয়ের নাম কতোই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যাই হোক পরে বুঝলাম ইংরেজি শব্দ পলি অর্থ বহুগুণ সমৃদ্ধ অর্থাৎ সেই সকল হাসপাতালে বহু বিষয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দেখলাম আমার ভাবনা ভুল এটা কোনো মেয়ের নামে হাসপাতাল নয়- এটা আমার মূর্খতা।
যা হোক যে দুটো শব্দ প্রথমে ঢাকায় এসে শিখেছিলাম, একটা শব্দ আমাকে কাঁদায় আর একটা শব্দ আমাকে হাসায়।
লেখক: মো. ইমরুল কায়েস, সমাজকর্মী এবং কলাম লেখক।