পৃথিবীব্যাপীই চলছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানা কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গোটা পৃথিবীতে ৭.৯ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ এখনো খাদ্যাভাবে রয়েছে। বাংলাদেশেও প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ ভালোভাবে খেতে পায় না। ফলে এ দেশের প্রতি ছয়জনের একজন পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। জুটছে না পর্যাপ্ত খাদ্য। আমাদের খাদ্য তালিকার প্রধান খাদ্য ভাত বা চাল। এই চাল দিয়েই আগামীতে কীভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, খাদ্যকে নিরাপদ করা যায় এবং একইসঙ্গে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব এমন সব লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্রি। জুনের প্রথম সপ্তাহে গাজীপুরে গিয়েছিলাম ধান নিয়ে ব্রির গবেষণা সম্পর্কে জানতে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) খাদ্য উৎপাদন এবং প্রবৃদ্ধিসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে অন্যতম ধান উৎপাদনকারী হিসেবে পরিচিত যেসব দেশ : ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডে ধান উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমছে। তবে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি আমরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রেখেছে মুখ্য ভূমিকা। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অব্যাহত রাখতে ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে তারা রাইস ভিশন নিয়ে কাজ করছে। আগামী ২০৫০-কে লক্ষ্য রেখে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে প্রথমত কম খরচে অধিক পরিমাণ ও মানসম্পন্ন ধান উৎপাদন করা। দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রোগবালাই, পোকামাকড়, সার, মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, বৈরী পরিবেশেও খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন জাত ও কলাকৌশল উদ্ভাবন করা। চতুর্থত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এগুলো করতে গিয়ে যে যে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তার অন্যতম হলো ধানের উৎপাদন ও রোগবালাই দমনে ন্যানো ফার্টিলাইজার ও ন্যানো পেস্টিসাইডের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা। যা দিয়ে ধানের নেক ব্ল্যাস্ট রোধ করা সম্ভব হবে বলছেন বিজ্ঞানীরা। কথা বলি ব্রি উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সি ফোর উদ্ভিদের মডেল হিসেবে তারা নিয়েছেন কাওনকে। কাওনের জিনকে ধানে ট্রান্সফার করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তারা। মনে পড়ল, ২০০৫ সালে সুযোগ হয়েছিল চীনের হুনান প্রদেশের চাংসায় হাইব্রিড ধানের জনক ইউয়ান লং পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের। সে সময় চীনে হাইব্রিড জাতের ধান চাষের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হতো ৯ টন। তিনি বলছিলেন, তারা ভুট্টার সি ফোর ধানে ট্রান্সফারের মাধ্যমে সুপার হাইব্রিড জাতের উদ্ভাবনের কাজ করছেন। যাতে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হবে ২২ টন।
এই সময়ে এসে ব্রিতে পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ধানে পানি ব্যবহার কমাতে ও নাইট্রোজেন বৃদ্ধির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে চলছে সি ফোর নিয়ে গবেষণা। এতে প্রতিকূল আবহাওয়াতেও ধানে অধিক সালোকসশ্লেষণ ঘটবে এবং কম পানিতেও ধান উৎপাদসক্ষম থাকবে।
আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে আবহাওয়ায় অধিক গরম থাকে। অতি গরমে ধান চিটা হয়ে পড়ে। এটি রোধে উচ্চতাপ সহনশীল জাত উন্নয়নেও কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। বলছেন, আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধানের দুটি জাত ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯-কে উচ্চতাপ সহনশীল জাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে পরিবর্তিত জলবায়ুর জন্য এ জাত খুব কাজে আসবে। আমরা এখন দেখছি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বাড়ছে।
জৈব প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাহানাজ সুলতানা জানালেন, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ ধানের জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএমও প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হচ্ছে ব্রিতে। ব্রি-৮৬ নামক ধানের জিনম এডিটিং করা হচ্ছে যা আগামীতে বোরো ও আমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
এখানে স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক রাইস টেস্ট ল্য্যাবরেটরিও। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবেষণার পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন তারা।
ল্যাবরেটরিতে চলছে চাল নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চালে কোনো ধরনের পেসটিসাইড কিংবা হারবিসাইড জাতীয় পদার্থ আছে কিনা তা টেস্ট করার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই ল্যাবরেটরিটি আন্তর্জাতিক মানদ-ে পৌঁছানোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
জানা গেল, সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন চালের পুষ্টিমান যাচাই-বাছাই করছে এখান থেকেই। গুড অ্যাগ্রিকালচার প্রাকটিস (গ্যাপ) নীতিমালা মেনে এই ল্যাবের সার্টিফিকেট গ্রহণ করে চাল রপ্তানি করা সম্ভব বলে জানালেন ব্রির শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হাবিবুল বারী সজিব।
নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জাতীয় লক্ষ্য সামনে রেখে ব্রি বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বিশ্বের সর্বপ্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি ৬২-সহ এই ধরনের ছয়টি জাত এবং পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি গুণাগুণ যেমন- প্রোটিন, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, গাবা ও প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এবং লো-জিআই এবং ঔষধি গুণাগুণ সংবলিত ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ ছাড়া মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে যাতে চালে সংযোজন করা যায়- এমন ধানের জাতও ব্রি উদ্ভাবন করেছে। এই নতুন ধরনের জাতগুলোর অবমুক্তকরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাদের লক্ষ্য শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো যেন চাল থেকেই পাওয়া যায়। গবেষণা শেষ হয়েছে ব্রি-২৯ অর্থাৎ গোল্ডেন রাইস যা ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ চাল নিয়েও। সরকারের পরিবেশ বিভাগের অনুমোদন পেলে এ ধানের বীজ মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চান তারা।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইরিতে গোল্ডেন রাইস নিয়ে কাজ শুরু হয় বহু আগে। একুশ শতকের প্রথম ভাগে ফিলিপাইনের লস বানোসে চলছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় মেগা ভ্যারাইটির বি আর ২৯ এ ভিটামিন-এ’র পুষ্টি সংযোজনের মাধ্যমে গোল্ডেন রাইস নিয়ে গবেষণার কাজ। সে সময় একাধিকবার সুযোগ হয়েছিল কাছ থেকে ওই গবেষণাগুলো দেখার। ইরির গোল্ডেন রাইস বিশেষজ্ঞ স্বপন দত্ত সেই ধানের জাত উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছিলেন।
আজকে বাংলাদেশের খাদ্য স্বয়ম্ভরতা অর্জনে ব্রির গবেষণা আমাদের এগিয়ে এনেছে বহুপথ। তবে বৈশ্বিক গবেষণা পর্যায়ের নিরিখে গতিটা যথেষ্ট মন্থর। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না গবেষণা। যত দ্রুত আর যতটা মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে ততটা দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়টিতে আমাদের আরও বেশি ত্বরিতকর্মা হতে হবে। পাশাপাশি সময়োপযোগী গবেষণার কথাই আমাদের ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে আধুনিক কৃষিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষককে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আগামীর কৃষির রূপকল্প এখনই নির্ধারণ না করতে পারলে বৈশ্বিক কৃষির পটপরিবর্তনে আমরা পিছিয়ে পড়ব প্রতিনিয়ত। আমরা জানি আজকের কৃষি, শুধু কৃষি নয়; এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের পুষ্টি চাহিদা ও সুস্বাস্থ্যের সার্বিক বিষয়াদি।
খাদ্য চাহিদার চ্যালেঞ্জ শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বের। কিন্তু উন্নত দেশগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই গ্রহণ করে ফেলেছে। গবেষকদের তথ্য মতে, বছরে পৃথিবীর আবাদি জমি কমছে ১০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা। এ আশঙ্কা আঁচ করেই বিশ্বের ধান উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ভারত এবং আমাদের বাংলাদেশে এখন ধানের বেশি বেশি ফলন প্রাপ্তি এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন ধান উৎপাদনে কাজ করছে। যা আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য জোগানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভিশন-২০৫০ লক্ষ্য পূরণ হলেই পূরণ হবে গোটা দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বড় অংশ।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব