সারা বছরই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে শোবিজ অঙ্গনের মানুষজনদের নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কখনো ইতিবাচক আর নেতিবাচকের জোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো মিডিয়া অঙ্গন। যা নিয়ে তর্ক-বির্তক চলে সবখানে। যার প্রমাণ মেলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই।
গেল ঈদে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে তিনটি সিনেমা। এগুলো হলো- রায়হান রাফির ‘পারাণ’, অনন্য মামুনের ‘সাইকো’ আর অনন্ত জলিলের বিগ বাজেটের সিনেমা ‘দিন : দ্য ডে’। পাশাপাশি ঈদে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও অনলাইনে প্রচার হয়েছে অসংখ্য নাটক, টেলিছবি। কিন্তু নাটক-টেলিছবিগুলো নিয়ে যতটা না কথা হয়েছে তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে মাত্র তিনটি সিনেমা ঘিরে। এ যেন সিনেমার বাইরে আরেক নাটক।
সমালোচনার শুরুটা হয় অনন্ত জলিল-বর্ষার বিগ বাজেটের সিনেমা ‘দিন : দ্য ডে’কে ঘিরে। এই সিনেমা নিয়ে নির্মাতা অনন্য মামুন মন্তব্য করায় তার উপর চটে যান অনন্ত। একটি টিভি অনুষ্ঠানের সাক্ষাৎকারে অনন্ত বলে বসেন, মামুনকে সামনে পেলে কান ধরিয়ে ওঠবস করাবেন তিনি। সে তর্কের হাওয়া লাগে ‘পারাণ’ সিনেমাতেও। অনন্ত সঙ্গে অতিথি হয়ে আসা ওই অনুষ্ঠানে বর্ষা বলেন, ‘রাজ (পরাণ সিনেমার নায়ক) নামের কাউকে চিনি না। একজন নায়িকার জামাই, সেটা শুনেছি।’
এরপর এই চিত্রনায়িকার আরেক বক্তব্য যেন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ‘আগুন’ লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। বর্ষার ভাষ্য ছিল, ‘কী টাইপের নায়িকা আপনাদের পছন্দ? সেই নায়িকা পছন্দ- যারা পেটে সন্তান নিয়ে কিংবা সন্তান প্রসব করে হাইডে (আড়ালে) থাকে? নাকি যারা হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা নিয়ে ধরা পড়ে পুলিশের হেফাজতে থাকে? যেসব নায়িকা বিয়ের শাড়িটাও স্পন্সর নিয়ে পরে তাদের পছন্দ? তাদেরকে অনন্ত জলিলের সঙ্গে মানাবে? আমি সেই গ্রেডের নায়িকা না। আমি আমার জায়গায় আছি।’ সিনেমাপাড়া যখন উত্তাল তখনো নাটকপাড়া শান্ত। তাদের ঘিরে ছিল না কোনো তর্ক-বিতর্ক।
সিনেমার এসব আলোচনা-সমালোচনার রেশ থাকাকালীনই মুক্তি পায় মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সিনেমাটি। মুক্তির পর এর নায়িকা নাজিফা তুষি’র পোস্টার সরানোকে কেন্দ্র করেও হয় তুমুল সমালোচনা।
এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক, চলতি বছর একই দিন (২৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও অভিনয় শিল্পী সংঘের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অথচ শিল্পী সমিতির নির্বাচনের ভোট গণনা ও ফলাফলকে কেন্দ্র করে এখনো বিতর্ক চলছে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। উল্টোদিকে, ওদিন রাতের ফলাফল মেনে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন টিভি পর্দার শিল্পীরা।
আর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদ নিয়ে তৈরি জটিলতার সুরাহ হয়নি আজও। যা এখনো আদালতের বিচারাধীন আছে। আর এই এক পদ নিয়ে নিপুণ আর জায়েদ খানের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। শুধু তাই নয়, সেই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পরে ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ ও মিশা-জায়েদ প্যানেল শিল্পীদের মাঝেও।
এদিকে, আবার খল অভিনেতা ডিপজলের ছেলের বিয়েতে মৌসুমীকে নিয়ে ওমর সানী ও জায়েদ খানের কাণ্ড তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় গেল জুনে। এ বিষয় নিয়ে কথাও বলেছেন চলচ্চিত্রের অনেক শিল্পীরাই। বাদ যায়নি শাকিব খানও। ‘এফডিসি কাজের জায়গা, এখানে কোনো সমিতি, পলিটিকস বা নির্বাচন থাকতে পারে না। যারা এসব করতে চায় তারা এফডিসির বাইরে গিয়ে করবে।’-এমন কথা বলে তোপের মুখে পড়েন এই সুপারস্টার। তার কথা শুনে মুখ খুলতে বাধ্য হন গুণী নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ, নির্মাতা দেলোয়ার ঝাহান ঝন্টুসহ অনেকেই।
এখন দেশেজুড়ে চলছে অনন্ত আর খল অভিনেতা মিশা সওদাগর কাণ্ড। অনন্তর বিগ বাজেটের সিনেমা ‘দিন : দ্য ডে’ দিয়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কোনো লাভ নেই বলে সমালোচনার মুখে পড়েছেন মিশা। যার জবাবে অনন্ত গেল শনিবার বলেন, ‘মিশা সওদাগর যখন শিল্পী সমিতিতে সভাপতি ছিলেন তখন প্রায় দুই শতাধিক শিল্পীর ভোটাধিকার বাতিল করা হয়েছিল। অথচ নিউজে সবসময় জায়েদ খানের নাম বলতে দেখেছি, মিশার নাম কম এসেছে। কিন্তু মিশা তো সভাপতি ছিলেন, শিল্পীদের বাদ দেওয়ার সই তো তিনিই করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিশার প্যানেল থেকে নির্বাচন করা এমন তিনজন শিল্পী আমাকে কল করে জানিয়েছেন, তাদেরকে মিশা বলেছেন, অনন্ত ভাইয়ের বিরুদ্ধে আমার কথা বলার একমাত্র কারণ উনি যাতে রাগ হয়ে শিল্পী সমিতিতে কোনো তহবিল না দেন।’ সবকিছু মিলিয়ে সিনেমাপাড়ায় এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এসব বিষয় নিয়ে দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন’র সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন গুণী নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ, বরেণ্য অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, ডিপজল, নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, সোহানুর রহমান সোহানসহ অনেকে। সবার কথা উঠে এসেছে, আমার নিজেরাই যদি নিজেদের সম্মান না করি, তাহলে অন্যরা কেন করবে। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি না করে, এক হয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। শিল্পীরা সমাজের সম্মানিত, তাই তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চলাফেরায় সর্তক হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির গুণী এই তারকারা।
অন্যদিকে, নাটকপাড়া সকল শিল্পীদের একসঙ্গে কাজ করা ও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হওয়ার বড় একটি কারণ হচ্ছে- তারা যেকোনো অনুষ্ঠান বা সভায় শিল্পীদের বারবার ‘সংযমী’ হওয়ার আহ্বান জানান। বিভেদ ভুলে একসঙ্গে থাকার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও অভিনেতা আহসান হাবিব দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের বড়দের থেকে শিখেছি সম্মান করার বিষয়টি। আমরা যত জনপ্রিয় শিল্পীই হই না কেন এখনো অনুষ্ঠানে সিনিয়র শিল্পীদের দেখলে আমরা ছুটে যাই। কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করি। আর আমাদের বার্ষিক সভা ও যে কোন অনুষ্ঠানে আমরা শিল্পীদের এক হয়ে চলা ও তাদের সম্মান করার বিষয়টি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। শুধু তাই নয়, কোনো শিল্পী ব্যক্তি বা কাজের জায়গা থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ আসলে আমরা তা সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে ফেরার চেষ্টা করছি। এসব কারণেই হয়তো ছোটপর্দার শিল্পীদের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের মাঝে দ্বন্দ্বটাও কম।’