‘মানুষে-মানুষে কোন ছিল না তফাৎ/ হাসিমুখে পরস্পরে মিলাইত হাত।/ বিলাসে আসিয়া ভেদ করিল সৃজন/ পর হয়ে গেল হায় যে ছিল আপন।’ ‘বিলাস’ কবিতায় কবি কালিদাস রায় এভাবেই জীবনকে ছেনে খুঁজেছেন তার মানে। কালিদাস কেমন কবি ছিলেন, তার কাব্য-প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে সমসাময়িক কবি মোহিতলাল মজুমদার লিখেছেন, ‘এখনও যে কবিতা প্রাণের ভাষা কয়, সে ওই আপনারই কবিতা,— তাতে পিতা-পিতামহের আত্মার আকুতি আছে, সে হচ্ছে খাঁটি বাঙালি প্রাণের কবিতা;— সৌন্দর্যের রসাবেশ নয়, কল্পনার অলকা-স্বপ্ন নয়, কাব্য-সুন্দরীর স্বয়ম্বর সভায় লক্ষ্যভেদের অপূর্ব কৌশল নয়। এখন চাই সেই সুর, যাতে সকল অভিমান, সকল গর্ব দূর হয়, প্রাণের তুলসীমূলে দীপ জ্বেলে সন্ধ্যা-সংকীর্তন-শেষে, এই আমার দেশের মাটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।’
কালিদাস ছিলেন রবীন্দ্রানুসারী কবি। লিখেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ; রম্যরচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জড়িত ছিলেন পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গেও। ‘বেতালভট্ট’ ছিল তার ছদ্মনাম। এই নামে বহু রসরচনা লিখে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
কবি কালিদাস রায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে। পিতা যোগেন্দ্রনাথ রায়। ছিলেন কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের কর্মচারী। আর বৈষ্ণব কবি লোচনদাস ঠাকুর ছিলেন তার পূর্বপুরুষ।
কাশিমবাজার আশুতোষ চতুষ্পাঠীতে শেখেন সংস্কৃত ভাষা। পরে কাশিমবাজারের খাগড়া লন্ডন মিশন স্কুলেও পড়াশোনা করেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কালিদাস বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্রে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক (১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ) হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। কিছুদিন (১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ) চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন।
কালিদাস কাব্যচর্চা তালিম নেন আত্মীয় রাধিকাচরণ বরাটের কাছে, যখন তিনি বহরমপুরে লন্ডন মিশনারি স্কুল ও আশুতোষ চতুষ্পাঠীর ছাত্র। রাধিকাচরণ বরাটের উদ্যোগেই কয়েকটি কবিতা নিয়ে ‘কুন্দ’ নামে (১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে) প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি রবীন্দনাথ ঠাকুর পড়ে লিখেছিলেন, ‘কাঁচা বয়সের লেখা’র স্তুতি-নিন্দার দিকে দৃকপাত না করে ‘অবহিত ভাবে সাধনা’ করতে। নবীনচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অক্ষয়চন্দ্র, অশ্বিনীকুমার গ্রন্থটি প্রকাশের পর কবিকে আশীর্বাদ করেছিলেন। রজনীকান্ত লিখেছিলেন, “তরুণ কবির সেই লেখা তার ‘রোগশয্যায় বেদনা-ক্ষতে’ স্নিগ্ধ প্রলেপ দিয়েছে।”
রবীন্দ্র ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েই পরে কালিদাস কাব্যচর্চা শুরু করেন। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল রোমান্টিকতা, প্রেম, পল্লীবাংলার শান্ত মাধুরী, সমাজ, ঐতিহ্যপ্রীতি এবং বৈষ্ণব প্রীতিরস। তিনি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এবং মেঘদূতের অনুবাদ করেন। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, শরৎ-সাহিত্য ও সাহিত্য প্রসঙ্গ তার সমালোচনা গ্রন্থ। তার মোট কাব্যগ্রন্থ ১৯টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো— কুন্দ (১৯০৮), ছাড়াও পর্ণপুট (১৯১৪), ঋতুমঙ্গল (১৯১৬), রসকদম (১৯২৩), হৈমন্তী (১৯২৪), লাজাঞ্জলি, ব্রজবেণু (১৯৪৫), চিত্তচিতা, পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যেও রয়েছে কালিদাস রায়ের বিশেষ অবদান। তিনি শিশুদের জন্য রচনা করেন পাঠ্যপুস্তকসহ বহু গ্রন্থ। তার উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যের গ্রন্থগুলো হচ্ছে— গাথাঞ্জলি (১৯৬১), গাথাকাহিনী (১৯৬৪), তৃণদল (১৯৭০), গাথামঞ্জরী (১৯৭৪), মনীষী বন্দনা (১৯৭৬), গাথাবলী (১৯৭৮)।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কালিদাস বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদের ‘কবিশেখর’ উপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) ও ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) লাভ করেন। কবি কালিদাস রায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।