‘পারিবো না’ এ কথাটি বলিও না আর,/কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার;/পাঁচজনে পারে যাহা,/তুমিও পারিবে তাহা,/পারো কি না পারো করো যতন আবার/একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ এ কবিতাটির যিনি রচয়িতা, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি ছিলেন সমগ্র পূর্ববঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের একজন কালীপ্রসন্ন ঘোষ। একাধারে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বাগ্মী।
জন্ম ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই ঢাকা বিভাগের বিক্রমপুরের ভরাকর গ্রামে। বাবা শিবনাথ ঘোষ ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক।
কালীপ্রসন্ন ঘোষের শিক্ষাজীবন বর্ণাঢ্য। পড়াশোনা করেছেন মক্তবে, চতুষ্পাঠী ও ইংরেজি স্কুলে। সংস্কৃত, ফারসি ও বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন বাল্যকালেই। শৈশবে পড়েছেন বরিশাল মিশনারি স্কুলে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে তিনি এনট্রান্স পাস করেন। একটু বিলম্বে হলেও ইংরেজি ভাষা তিনি আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এজন্য কলকাতায় যান। সেখানে ইংরেজি ভাষায় সমান পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইংরেজিতে লিখতে-পড়তে, এমনকি অনর্গল কথা বলতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
তবে ইংরেজি ভাষা যখন পুরোপুরি আয়ত্তে চলে আসে, ঠিক তখনই কালীপ্রসন্নের মনোজগতে আসে এক বিশাল পরিবর্তন। রেভারেন্ড ডালের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনিই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ইংরেজি ভাষার প্রতি মোহ কমিয়ে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা জোরদার করতে। এ উপদেশের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরে কালীপ্রসন্ন যে কারণেই হোক, পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেন এবং সফল হন সৃষ্টিশীল রচনায়।
কথা বলতে কালীপ্রসন্ন ঘোষ যে খুব পটু ছিলেন, তার পরিচয় দেন শৈশবেই। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি কলকাতার ভবানীপুরে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে বক্তব্য দিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ মনীষীদের প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। এরপর থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তার একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন।
কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট সভ্য। সাংবাদিকতা শুরু করেন ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা শুভসাধিনী সভার’ মুখপত্র ‘শুভসাধিনী’ সম্পাদনার মাধ্যমে। এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন ঢাকার ব্রাহ্ম-যুবকদের জন্য। ৪ বছর পর ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সম্পাদনা করেন সেই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘বান্ধব’।
২২ বছর বয়সে কালীপ্রসন্ন ঘোষ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নিম্ন আদালতে পেশকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১১ বছর চাকরি করার পর তিনি ভাওয়াল এস্টেটের প্রধান দেওয়ান হিসেবে যোগ দেন এবং ভাওয়ালের যথেষ্ট উন্নতি করেন। এখানে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। এ সময় তিনি ‘সাহিত্য-সমালোচনী সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সদস্য এবং সহসভাপতির পদও তিনি অলঙ্কৃত করেন। এ ছাড়া তিনি সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সদস্য এবং সদর লোকাল বোর্ডের সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
কালীপ্রসন্ন মূলত দর্শন ও সমাজ সম্পর্কে লিখতেন। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলো হলো- প্রভাত-চিন্তা (১৮৭৭), নিভৃত-চিন্তা (১৮৮৩), নারীজাতিবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৯৬), নিশীথ-চিন্তা (১৮৯৬)। অন্য গ্রন্থগুলো হলো ভ্রান্তিবিনোদ (১৮৮১), প্রমোদলহরী (১৮৯৫), ভক্তির জয় (১৮৯৫), মা না মহাশক্তি (১৯০৫), জানকীর, অগ্নিপরীক্ষা (১৯০৫), ছায়াদর্শন (১৯০৫) প্রভৃতি। এ ছাড়া সঙ্গীতমঞ্জরী (১৮৭২) নামে একখানা আধ্যাত্মিক সংগীতসংগ্রহ এবং কোমল কবিতা (১৮৮৮) নামে একটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থও রচনা করেন।
ইংরেজ সরকার তাকে পান্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রায়বাহাদুর এবং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সিআইই উপাধি প্রদান করে। বাংলার পণ্ডিতরা তাকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে অভিষিক্ত করেন। এই গুণী সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বাগ্মী ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
অদ্বৈত মারুত: শিশুসাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক