এই যে কবিতা ভালো লাগা, কবিতার প্রতি ভালোবাসা, ভাবনার অতলে তলিয়ে যাওয়া, শব্দের প্রতি মোহগ্রস্ত হওয়া- শৈশবেই এ বোধটি যাদের কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল, সুফিয়া কামাল তাদের অন্যতম। তার রচিত ‘হেমন্ত’ কবিতা শৈশবে যেভাবে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল, আজও সেই একইভাবে হৃদয় আবিষ্ট করে রাখে। সেই একইভাবে শৈশব, কৈশোরের গ্রাম, তার পরিপার্শ্ব দৃশ্যের পর দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানসপটে। যখন পড়ি-
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।
আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।
হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।’ [হেমন্ত, সুফিয়া কামাল]
দৃশ্যের পর দৃশ্যগুলোর ভেতর দিয়ে প্রকৃত অর্থে আমি আমাকেই খুঁজে পাই। বেগম সুফিয়া কামাল এভাবেই অসংখ্য শিশু-কিশোরের মানস গঠনে এমন অনন্য, অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন।
আজ এই মহীয়সী ও মহৎপ্রাণ নারীর মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের শায়েস্তাবাদে, নানাবাড়ি; ১৯১১ সালের ২০ জুন। তার পৈতৃক নিবাস ত্রিপুরার শিলাউর গ্রামে। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, বুদ্ধিজীবী, সমাজনেত্রী।
বেগম সুফিয়া কামালের বাবা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। সুফিয়ার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার বাবা নিরুদ্দেশ হন। বাবার অনুপস্থিতি মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন মোটেও বুঝতে দেননি। অপার স্নেহ-লালিত্য আর পরিচর্যায় তাকে বড় করে তোলেন। শৈশবে তিনি মুক্তাঙ্গনের কোনও বিদ্যাপীঠে গমন করার সুযোগ পাননি। ঘরের মধ্যেই আরবির পাশাপাশি শিখতে শুরু করেন বাংলা ভাষা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা ও পড়ার ঝোঁক। অল্প বয়সেই কবির বিয়ে হয় জ্ঞাতিভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। দুঃখের বিষয় হলো, নেহাল হোসেন অকালেই মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় বিয়ে হয় চট্টগ্রাম জেলার চুনতি গ্রামের কামালউদ্দিনের সঙ্গে। এর পর তিনি স্বামীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন কলকাতায়।
কলকাতাতেই সাক্ষাৎ ঘটেছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়া-দর্শনের সেই স্মৃতি এবং বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিত্বে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শৈশবকালেই। স্বামীর উৎসাহে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’। প্রকাশিত হয় বরিশালের তরুণ পত্রিকায়।
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ১৯২৫ সালে বরিশালে সাক্ষাৎ সুফিয়া কামালের জীবনের আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়। গান্ধীর স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুফিয়া কিছুদিন চরকায় সুতা কাটেন। এ সময়ই তিনি নারীকল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’-এ যোগদান করেন এবং নারীকল্যাণে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
কলকাতায় সুফিয়ার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ বাঙালি ব্যক্তিত্বের সাক্ষাতের মধ্যদিয়ে তিনি নিজেকে ঋদ্ধ করতে থাকেন। তখন কবি কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন কৃষ্ণনগরে। ‘অভিযান’ পত্রিকার মাধ্যমে ইতোমধ্যে তিনি সুফিয়া কামাল সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং পত্রালাপের মাধ্যমে পরিচয়ও ঘটেছিল। সরাসরি সাক্ষাৎ তখনো ঘটেনি। নজরুল একদিন শুনলেন, সুফিয়া কামাল কলকাতায় এসে বসবাস করতে শুরু করেছেন। তখন তিনি নিজেই গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এভাবেই কবি সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। নজরুলের মাধ্যমেই ‘সওগাত’ পত্রিকা এবং পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরউদ্দিনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময়ই তিনি কবি খান মোহাম্মদ মইনুদ্দিন ও কবি বেনজীর আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন। কবি বেনজীর আহমদের সহযোগিতা ও উৎসাহে বেগম সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতার বই ‘সাঁঝের মায়া’ এবং পরে আরও একটি গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়।
বেগম সুফিয়া কামালের জীবনের আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ। তিনি বিশ্বকবির জন্মদিনে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। এর কিছুদিন পরই পত্রের উত্তর আসে তেমনই আরেকটি কবিতার মাধ্যমে। বিশ্বকবির কবিতা পাওয়া এবং তার সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি খুব খুশি হন। বিশ্বকবির সঙ্গে সুফিয়া কামালের সাক্ষাৎও ঘটে। কবিগুরু তাকে ‘গোরা’ উপন্যাসটি উপহার দেন। এর পর আরও একাধিকবার তিনি রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।
সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সুফিয়া কামাল ছিলেন সবার ‘সাহসিকা জননী’। বেগম রোকেয়ার সামাজিক আদর্শ তিনি আজীবন লালন করেছেন। নারীশিক্ষা, সামাজিক সংস্কারসহ নারী উন্নয়নে অসংখ্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। রচনা করেছেন গ্রন্থ। রোকেয়ার ওপর লিখেছেন অনেক কবিতা। তার নামে ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ শীর্ষক সংকলন বেগম রোকেয়াকেই উৎসর্গ করেন। ‘রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠনে সহায়তা করেন আর যার প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী হলের নামকরণ করা হয় ‘রোকেয়া হল’।
সুফিয়া কামাল শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘজীবন। শুরু করেছিলেন কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে। এখানেই পরিচয় ঘটে প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির ও জসীমউদদীনের সঙ্গে। শিক্ষকতা ও লেখালেখির মধ্যেই সুফিয়া কামাল নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেননি, যে কোনো আন্দোলন, সংগ্রাম তথা সাধারণের অধিকার আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাপীড়িতদের সাহার্য্যর্থে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি ১৯৪৮ সালে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষায়ও রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নিয়েছেন সরাসরি অংশগ্রহণ। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে তার দুই কন্যা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য হাসপাতাল স্থাপনে অংশ নেন।
সুফিয়া কামাল সারাজীবন ১৬টি সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। পদক পেয়েছেন ৩২টি। তার উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, প্রশান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, স্বনির্বাচিত কবিতা সঙ্কলন। গল্পগ্রন্থ- কেয়ার কাঁটা, মোর দাদুদের সমাধির পরে। ভ্রমণকাহিনী- সোভিয়েটের দিনগুলো। স্মৃতিচারণ- একাত্তরের ডায়েরি। শিশু-কিশোর রচনা- ইতল বিতল, নওল কিশোর এবং একমাত্র উপন্যাস অন্তর। তার রচিত কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রুশ ভাষায় তাঁর সাঁঝের মায়া গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও তাঁর বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি তাঁর কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে Mother of Pearls and Other Poems এবং ২০০২ সালে সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ করে।
সুফিয়া কামাল সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য লাভ করেছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ নামক জাতীয় পুরস্কার প্রদান করে কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে সুফিয়া কামাল তা বর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য পুরস্কার হলো- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), Women’s Federation for World Peace Crest (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) ইত্যাদি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medal (১৯৭০) এবং Czechoslovakia Medal (১৯৮৬) সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন।